‘তহন তো আর মোবাইল আল্লে না। স্কুলে যাওয়ার কালে নদীর ওপাড়ের ভানুরে বোলাইতাম, ও ছোডো নৌকা লইয়া এই পাড়ে আইতো। হেইরপর দুইজনে স্কুলে যাইতাম। ৪০ বছর ধইরা খালি ভাঙ্গে আর ভাঙ্গে। এহন আর ভানু মোর কথা হোনে না। ভানুর কথা হোনা তো দূরের কথা এহন আর ভানুরে চোহেও দেহি না। বিষখালী সব খাইছে। বিষখালীর সূর্য ডোবা দেখতে বরগুনা দিয়াও মানুষ আয়। খুব সুন্দর লাগে হেগো ধারে। আর মোগো সব খায় ও। মোগো জানের শত্রু বিষখালী। ওরে দেখতে সুন্দর হইলে কাম হইবে কি, আসলে ও সর্বনাশা।’
বরগুনা সদর উপজেলার নলটোনা গ্রামের ৬৮ বছরের বৃদ্ধা আনোয়ারা বেগম কথাগুলো রাইজিংবিডিকে বলছিলেন। ২০১৫ সালের সুপার সাইক্লোন সিডরে এই নদীর পানিতেই ভেসে গেছে তার স্বামী। তারপর আর খোঁজ মেলেনি। বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা জলচ্ছ্বাসে এখন আর ভয় লাগে না তার। ভয় শুধু ভাঙন নিয়ে। ৪০ বছরে ১২ বার তার বসতঘর ভাঙনের কবলে পড়েছে।
আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘এই নদী তিলে তিলে ভাঙে। তাই কেউ গুরুত্ব দেয় না। ফসলি জমি ছিল দুই বিঘা, তাও গিলে খেয়েছে বিষখালী। একমাত্র ছেলে এখন অভাবের তাড়নায় দিনমজুরি কাজ করে। অভাবের সংসারে তিন বেলা খাবার জোটে না। এর মধ্যে যদি ১২ বার থাকার ঘরটিও ভাঙনে পড়ে, তার কী থাকে?’
একই এলাকার বাসিন্দা মন্নান মিয়া, দেলোয়ার হোসেন ও ফারুক চৌকিদার রাইজিংবিডিকে জানান, বিষখালীর তীব্র ভাঙনে অতিষ্ট তারা। শীত মৌসুমেও অনবরত ভাঙতে থাকে। তবে বর্ষা মৌসুমে ভাঙনের মাত্রা বাড়ে কয়েকগুন। ভাঙতে ভাঙতে এখন ঐতিহ্যবাহী নলী বন্দরও হুমকির মুখে। স্থায়ীভাবে বেড়িবাঁধ তৈরি না করলে নলী বন্দরসহ নলী বাজারও বিলীন হয়ে যাবে।
নলী বন্দরের জেলেরা বলেন, ‘দক্ষিণ অঞ্চলে সর্বপ্রথম মাছের সর্ববৃহৎ বাজার ছিল নলী বন্দর। বঙ্গোপসাগরের বেশিরভাগ জেলে এই বন্দরেই মাছ বোঝাই ট্রলার ভিড়াতো। এরপরে পাথরঘাটায় মৎস্য অবতরণকেন্দ্র হয়। তার পরেও এই বন্দরের চাহিদা কমেনি। সাগর থেকে খুব কাছে হওয়ায় এখানেই এখনও জেলেরা আসেন। মাছ বিক্রি করে আবার এই বাজার থেকেই বরফসহ প্রয়োজনীয় খাবার সামগ্রী নিয়ে তারা সাগরে মাছ ধরতে চলে যায়। কিন্ত সেই বাজার এখন হুমকির মুখে। ব্লক দিয়ে স্থায়ীভাবে বেড়িবাঁধ নির্মাণ না করলে এই বাজার ভাঙনের কবলে পড়বে।’
স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, ‘স্থায়ীভাবে বেড়িবাঁধ নির্মাণ না করায় প্রতি বছর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ফসলি জমি, মাছের ঘের ও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। জরুরি ব্লক দিয়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ না করলে নদীগর্ভে চলে যাবে পুরো নলটোনা ইউনিয়ন।’
সাপাহার এলাকার কয়েকজন কৃষক জানান, বেড়িবাঁধ ভাঙা। তাই জোয়ারের পানি সামান্য বাড়লেই ফসলি মাঠে জোয়ারের পানি ঢুকে যায়। লবণাক্ত পানির কারণে ফসল নষ্ট হয়। প্রতি বছরই কৃষকদের লোকসান দিতে হয়।
তারা আরও বলেন, ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে যখন প্রত্যেক বছর ভরা বর্ষায় অতিরিক্ত পানি প্রবেশ করে তখন পানি উন্নয়ন বোর্ড জরুরিভাবে মেরামত করে। মাস না যেতেই আবার সেসব জায়গা ছুটে গিয়ে পানি প্রবেশ করে এলাকায়। বার বার জরুরি মেরামত না করে সেই টাকা দিয়ে এক সঙ্গে স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণ করলে সরকারের টাকারও অপচয় হবে না, ভাঙনের হাত থেকে রেহাই মিলবে।
ভাঙন রোধ করতে নানান পরিকল্পনার কথা জানিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী কাইছার আলম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘বরগুনা উপকূল রক্ষায় পর্যায়ক্রমে সবকয়টি বেড়িবাঁধ স্থায়ীভাবে নির্মাণ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবও পাঠানো হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসেব মতে, জেলার ৮০৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের আটটি পয়েন্ট সম্পূর্ণ ও ২৬টি পয়েন্ট আংশিক ক্ষতিগ্রস্তসহ প্রায় ৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন