একটা সময় ছিল যখন সিলেটের অন্যতম দুই রূপবতী দী সুরমা ও কুশিয়ারার এ-কূল থেকে ও-কূল তাকালেই চোখে পড়তো বিশাল জলরাশি আর ঢেউয়ের পর ঢেউ। কিন্তু কালের পরিক্রমায় যৌবনঠাসা সেই নদী দুটি এখন মরতে বসেছে। তাদের বুকে জাগছে মৃত চর। যৌবনের জৌলুস হারাচ্ছে সবুজ ঘেরা সিলেটের এ দুই নদী। বিশাল বিশাল চর জেগে উঠার পাশাপাশি দখলবাজরা নদীর বুকে অবাদে নির্মাণ করছে ঘরবাড়ি ও দোকানপাট। শতচ্ছিন্ন চেহারা নিয়ে সুরমা ও কুশিয়ারার আজ যেন চরম অচেনা দৈন্যদশা।
শত আঘাতেও যেটুকুই জীবিত রয়েছে তা-ও ভূমিদস্যুদের ভরাটের কবলে মরতে বসেছে। তাছাড়া পাথর ও বালু উত্তোলনেও নদী অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অবৈধভাবে নদী দখল ও দূষণের এসব ভয়ংকর চিত্র সিলেটজুড়ে।
এতে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন পরিবেশবাদীরা। তারা বলছেন, নদীর অভিভাবকদের চরম উদাসীনতার কারণে অবৈধ দখলদারদের দখল ভরাট হচ্ছে নদীর দুই তীর। এসব নদী বাঁচাতে দখলদারদের উচ্ছেদের বিকল্প নেই।
সরকারি হিসাব বলছে, সিলেটের প্রধান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারাসহ ৭-৮টি নদীর প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার তীর নদী খেকোদের দখলে রয়েছে। দখলের সঙ্গে জড়িত রয়েছে শতাধিক ব্যক্তি ও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। বাস্তবে এ সংখ্যা হাজারের বেশি। দখলবাজরা শুধু নদীর দুই পাড় দখল করেই ক্ষান্ত হয়নি। তারা প্রবাহমান নদীর পানিতে বাঁশ-কাঠের মাচা তুলে বানিয়েছে ঘরবাড়ি-দোকানপাট। তাছাড়া নদীর তীর কেটে বালু ও মাটি উত্তোলন করে লুটে নিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় প্রভাবশালীরা বিভিন্নভাবে গিলে খাচ্ছে এক সময়ের প্রমত্তা নদীগুলো।
এদিকে দখল হওয়া এসব নদীর তীর উদ্ধারে নেই কোন তৎপরতা। গত দুই বছরে সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকায় সুরমা নদীর তীর দখল করা ২৪ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এর বাইরে দু-একটি জায়গায় উচ্ছেদ অভিযান চললেও জেলার বিভিন্ন উপজেলায় নদী খেকোদের উচ্ছেদে নিশ্চুপ প্রশাসন।
পরিবেশবাদীদের দাবি, নদীরক্ষায় সরকারের কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। সিলেটে কতটি নদী রয়েছে, কতটি ভরাট হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়েছে তারও কোনও সঠিক পরিসংখ্যান নেই। এমনকি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন নদীর তীর দখলবাজদের যে তালিকা প্রকাশ করেছে সেটিও ত্রুটিপূর্ণ বলে দাবি তাদের।
সেভ দ্য এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হেরিটেজ-এর প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হাই আল হাদী ব্রেকিংনিউজকে বলেন, ‘নদীর অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে প্রশাসনের চরম উদাসীনতা রয়েছে। শুধুমাত্র সিটি করপোরেশন এলাকা ছাড়া এর বাইরে কোনও অভিযান হয় না। তাতে বোঝা যাচ্ছে নদীর প্রতি তাদের দরদ নেই।’
তিনি বলেন, ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন নদীর অবৈধ দখলদারদের যে তালিকা প্রকাশ করেছে তা সঠিক নয়। এর বাইরে অনেক দখলদার রয়েছে। প্রতিটি নদীর পরিদর্শন করে এই তালিকা প্রকাশ করা দরকার। এরই আলোকে ঘন ঘন উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে নদীকে অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।’
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, সিলেটের সুরমা নদীর ১২০০ মিটার, কুশিয়ারা নদীর ১৪৫০ মিটার, গোয়াইন নদীর ১০০ মিটার, মাকুন্দা নদীর ১১০ মিটার, ধলাই নদীর ৮০০ মিটার, তৈমুর নগর নদীর ৪০ মিটার, সূর্যখালী খালের ৩০০ মিটার জায়গা অবৈধ দখলদারদের কবলে রয়েছে। এসব দখলকৃত জায়গায় গড়ে উঠেছে বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা।
সুরমা নদী
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকায় সুরমা নদীর ৪৫০ মিটার জায়গা ২৩ জন অবৈধ দখলদারের দখলে। তারা নদী তীরবর্তী স্থানে ৭২টি স্থাপনা গড়ে তুলেছেন। অবশ্য ২০১৯ সালের নভেম্বরে তাদেরকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। তবে সরেজমিনে দেখা গেছে উচ্ছেদ হওয়া স্থান ফের দখলে নিয়ে যাচ্ছেন স্থানীয়রা। এছাড়া কানাইঘাট বাজারে সুরমা নদীর ২৫০ মিটার দখল করে রেখেছেন স্থানীয় ৬ জন নদী খেকো। সেখানে ২৩টি অবৈধ স্থাপনা গড়ে তুলেছেন তারা। ওই উপজেলার গাছবাড়ি এলাকায় সুরমা নদীর ৩০০ মিটার অবৈধ দখলদারদের দখলে রয়েছে। একই উপজেলার গাছবাড়ি এলাকায় সুরমার ৩০০ মিটার দখল করে স্থাপনা নির্মান করেছেন ২৫ নদীখেকো।
কুশিয়ারা নদী
সিলেটের বালাগঞ্জে এ নদীটির ২৫০ জায়গা দখল করে অবৈধভাবে ২০টি স্থাপনা গড়ে তুলেছেন স্থানীয় ২০জন নদী খেকো। এছাড়া এই উপজেলায় শাহজালাল ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি ও কুশিয়ারা পাওয়ার প্ল্যান্ট নদীটির ১০ মিটার জায়গায় তাদের স্থাপনা নির্মাণ করে দখলে রেখেছে। গোলাপগঞ্জ উপজেলার বুধবারবাজার এলাকায় কুশিয়ারা ৩০০ মিটার তীর দখল করে ২০টি স্থাপনা নির্মাণ করে দখলে রেখেছেন স্থানীয় চন্দরপুর এলাকার ১৭ জন দখলবাজ। ফেঞ্চুগঞ্জে কুশিয়ারার ৯০০ মিটার তীর দখল করে ৩৫ টি পাকা, আধা পাকা ও টিনশেডের ঘর নির্মাণ করে দখলে রেখেছে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
গোয়াইন নদী
এছাড়া গোয়াইনঘাট উপজেলায় গোয়াইন নদীর ১০০ মিটার দখল করে ৪টি স্থাপনা গড়ে তুলা হয়েছে। এসব জায়গা দখল করে স্থাপনা গড়ে তুলেছে খোদ উপজেলা পরিষদ।
মাকুন্দা নদী
সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার সিঙ্গেরকাচ বাজারে এই নদীটির ৬০ মিটার তীর দখল করে ১২টি স্থাপনা নির্মাণ করে দখলে রেখেছে ব্যবসায়ীরা। লামাটুকেরবাজার এলাকায় নদীটির আরো ১০ মিটার জায়গায় অবৈধভাবে নির্মাণ করা হয়েছে ৩টি স্থাপনা। সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার মোহাম্মদপুর বাজারে মাকুন্দার ৪০ মিটার জায়গাও দখল করে ৯ টি স্থাপনা তৈরি করে দখলে ভোগ করে আসছেন ব্যবসায়ীরা।
ধলাই নদী
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার এই নদীটির ৪০০ মিটার জায়গায় রয়েছে পাকা-আধা পাকা ও টিনশেডের ৩৫টি৫ স্থপনা। এই নদীটির দখলদারদের চিহ্নত করতে পারেনি পাউবো। মরা পাথররাজ্য খ্যাত ধলাই সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ নদী উপজেলার এই মরা ধলাই নদিটির ৪০০ মিটার অবৈধ দখলদারদের দখলে। সেখানে পাকা ঘর ও দোকান কোটাসহ ৩৫টি স্থপনা নির্মাণ করে রেখেছেন স্থানীয়রা। এই দখলদরদের নাম চিহ্নিত করতে পারেনি পাউবো। তবে স্থানীয়দের তথ্য মতে এই নদীটি প্রায় নিশ্চিহ্ন।
তৈমুর নগর নদী
প্রায় ১৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই নদীটি দখল-ভরাটে একেবারে নিশ্চিহ্ন। তবে পাউবোর তথ্যমতে, এই নদীটি ৪০ মিটার জায়গা দখল করে পাকা ঘর টিনশেডের দোকানসহ ১৯টি স্থপনা নির্মাণ করা হয়েছে। তবে স্থানীয়রা বলছেন, দখল, দূষণ ও ভরাটে এই নদীর অস্তিত্বই নেই।
সূর্যখালী খাল
সিলেটের পাথর রাজ্য কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার আরেকটি খাল সূর্যখালী খালও রয়েছে নদী খেকোদের দখলে। এই খালের ৩০০ মিটার জায়গা দখল করে ২৫টি স্থাপনা নির্মাণ করে রেখেছেন স্থানীয়রা। পাউবো এসব দখলদারদের তথ্য খুঁজে পায়নি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী শহীদুজ্জামান সরকার ব্রেকিংনিউজকে বলেন, ‘নদীর অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে অভিযান অব্যাহত আছে। সরকার যখন কোনও সিদ্ধান্ত নেয় তখন সরকারের বিপক্ষে কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দাঁড়াতে পারে না। নদীর দখলদার অনেকভাবে, অনেক জায়গাতেই তদবির করেছে। কিন্তু যখন তারা বুঝতে পেরেছে এটা সরকারি সিদ্ধান্ত তখন তারা নিজ উদ্যোগেই এসব স্থাপনা সরিয়ে নিয়েছে।’
নদীর তীরবর্তী স্থানে কেউ বাজার বা স্থাপনা গড়ে তুলতে পারবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, নদীর তীরে এমনভাবে কিছু ওয়াকওয়ে তৈরি করা উচিত যাতে এসব স্থান কেউ দখল করতে না পারে। পাশাপাশি সবাইকে সচেতন হওয়ারও আহবান জানান তিনি।
সিলেটের জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন গঠন করা হয়েছে। নদীগুলো যাতে দখলমুক্ত থাকে সেই ব্যাপারে কমিশন বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়ে থাকে। সে মোতাবেক আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটি চলমান প্রক্রিয়া। অবৈধভাবে দখল যাতে না হয় সেই বিষয়ে সরকারের নির্দেশনা আছে। পাশাপাশি উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও রয়েছে। নদীতে চর পড়বে এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে আমাদের দেখতে হবে এই চর পড়ার কারণে চলাচলে সমস্যা হচ্ছে কি-না।’
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন