বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমান অনুযায়ী, প্রায় ৪৬ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষ কানে ঠিকমত শুনতে পান না৷ অনেকে কম শোনেন, কেউ আবার জন্ম বধির৷ আংশিক বা সম্পূর্ণ বধিরতা মানুষের ইন্দ্রিয়র সবচেয়ে বড় রোগ৷ একজন মানুষ জন্মগতভাবে বা জন্মের পর এ সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারেন। জন্মগতভাবে বধির শিশু বা ব্যক্তিরা, বিশেষ করে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হয়।
শ্রবণ সংক্রান্ত সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা নিয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে ‘ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব ডেফ’-এর উদ্যোগে ১৯৫১ সালে রোমে প্রথম শ্রবণ প্রতিবন্ধকতা দিবস পালন শুরু হয়। কানে শুনলে তবেই বাচ্চারা কথা বলতে শেখে। কিন্তু জন্ম থেকেই যদি বাচ্চার কানের কোনও শব্দ না পৌঁছয় তাহলে কথা বলতে শেখার কোনও প্রশ্নই নেই।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১০০ জন শিশুর মধ্যে ৪ জন স্বাভাবিকভাবে শুনতে পায় না। অথচ বাবা মা বা পরিবারের অন্যরা সে বিষয়ে সচেতন নন। ফলে বাচ্চার কথা বলতে শেখে না। বিসিজি বা অন্যান্য টিকার মত ইউরোপ আমেরিকায় সদ্যোজাত শিশুর শ্রবণ ক্ষমতা পরীক্ষার করা বাধ্যতামূলক।
জন্মের সময় শ্রবণ শক্তি স্বাভাবিক থাকলেও ৩/৪ বছর বয়সে মেনিনজাইটিস, টাইফয়েড বা এনকেফেলাইটিস হলেও শ্রবণ ক্ষমতা কমে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। অন্য অনেক অসুখের মতই কানে শোনার অসুবিধা যদি জন্মের সময় নির্ণয় করা যায়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে হিয়ারিং এড দিয়ে বা দরকার হলে ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট করে শিশুকে শব্দের জগতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে ককলিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারি পদ্ধতি এক অভিনব চিকতিসা পদ্ধিতি। যারা কানে শোনেন না কিম্বা একেবারেই কম শোনেন তাদের চিকিৎসা করা হয় এই সার্জারির মাধ্যমে। ককলিয়ার ইমপ্লান্ট একটি ইলেকট্রনিক যন্ত্র যার একটি অংশ সার্জেনরা অপারেশন করে কানের ভেতর বসিয়ে দেন যা আমৃত্যু কার্যকর থাকে। বাকি অংশটুকু কানের পেছনে লাগিয়ে শব্দ শোনা যায় প্রায় একেবারেই স্বাভাবিকের মতো। কানে শোনার ক্ষেত্রে যাদের জন্মগত সমস্যা রয়েছে তাদের বেলায় ১০ মাস থেকে ৫ বছরের মধ্যে ককলিয়ার ইমপ্লান্ট করলে কানে ভালো শুনতে পাবে।
তাছাড়া যাদের বয়স বেশি তারাও অপারেশন করালে ভালো শুনতে পাবেন। তবে ককলিয়ার ইমপ্লান্ট যন্ত্রের নাম মোটেও কম নয়। তাই এ যন্ত্রটি সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা উচিত।
চিকিৎসকদের মতে, গর্ভাবস্থায় হবু মায়ের কোনও অসুখ যেমন মাম্পস, রুবেলা, হারপিস, চিকেন পক্স বা টক্সোপ্লাসমোসিসের মত ভাইরাস ঘটিত সংক্রমণ হলে শিশু জন্মগত ভাবে শ্রবণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। গর্ভাবস্থায় মা যদি এমন কিছু ওষুধ খান, যার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে, তখন বাচ্চা বধির হয়ে জন্মাতে পারে। সন্তান ধারণের সময় ওষুধ খাবার ব্যাপারে সচেতন থাকা উচিত।
চিকিৎসকের দেওয়া ফলিক অ্যাসিড বা আয়রন ছাড়া অন্য কোনও ওষুধ খাওয়া ঠিক নয়। অবশ্য হাই প্রেশার সুগার বা অন্যান্য ক্রনিক অসুখ থাকলে তার
ওষুধ খেতেই হবে। আবার গর্ভাবস্থায় হবু মায়ের চোট লাগলেও শিশুর শ্রবণযন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কানের গঠনগত কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি থাকলে বাচ্চা বধির হয়ে জন্মায়। অনেকে আবার ছোট বয়সে নানা শারীরিক কারণে শ্রবণ ক্ষমতা লোপ পায়।
কান বা শ্রবণযন্ত্রের বিশেষ করে অন্তঃকর্ণের কোনও গঠনগত ত্রুটি থাকলে জন্মের সময় থেকেই বাচ্চা কানে শুনতে পায় না। শোনার জন্য প্রয়োজনীয় নার্ভ অডিটরি নার্ভ। এই স্নায়ুর আশেপাশে কোনও টিউমার থাকলে কানে শোনার সমস্যা হয়। বংশগত কারণেও বাচ্চা বধির হয়ে জন্মাতে পারে। আবার জন্মের সময় কোনও সমস্যা না থাকলেও জন্মের পর নানা কারণে শ্রবণ ক্ষমতা কমে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রেও অবিলম্বে সঠিক চিকিৎসার সাহায্য না নিলে কথা বলা-সহ ব্যক্তিত্ব বিকাশে অসুবিধা হয়। অ্যাকোয়ার্ড অর্থাৎ জন্মের পর নানা কারণে শিশুর শ্রবণ যন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয় । যে সব বাচ্চা নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই ভূমিষ্ঠ হয় ও স্বাভাবিকের থেকে অনেক কম ওজন নিয়ে জন্মেছে, তাদের ক্ষেত্রে এমন সমস্যা হতে পারে।
আঘাত বা অন্য কোনও কারণে কানের পর্দা ক্ষতিগ্রস্ত হলে এবং সময়মতো চিকিৎসা না হলে বাচ্চার কানে শোনার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। বাচ্চারা কানে কিছু পুরে দিলে এবং তা কানের মধ্যে থেকে গেলে শ্রবণযন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
কানে ময়লা জমে খোঁচাখুঁচি করতে গেলে কানের পর্দা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ফলে শোনার ক্ষমতা ধীরে ধীরে লোপ পায়। খেয়াল রাখুন কোনও শব্দ হলেই বাচ্চা মাথা ঘুরিয়ে তাকায়, বা চমকে ওঠে কিনা। একটু বড় হলে মা বাবার গলা চিনতে পারে। ১৫ মাস বয়সে বাচ্চারা মা, বাবা, দাদা ইত্যাদি বলতে শেখে। না বলতে পারলে বুঝতে হবে সমস্যা আছে। এক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে।
পরীক্ষা করে যদি জানা যায় শ্রবণ সহায়ক নার্ভ দুর্বল, তবে ছোট বয়স থেকেই ‘হিয়ারিং এড’ দিতে হবে। উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন ‘ডিজিটাল হিয়ারিং এড’ কানে শোনার সব ঘাটতি দূর করতে পারে। ছোট থেকে ‘হিয়ারিং এড’ নিলে বাচ্চারা চট করে মানিয়ে নিতে পারে। ভবিষ্যতে কোনও সমস্যাও হয় না। যদি কোনও বাচ্চার ককলিয়ার নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে ‘হিয়ারিং এড’ দিয়েও কোনও লাভ হয় না। এদের শ্রবণ ক্ষমতা ফিরিয়ে আনার এক মাত্র উপায় ককলিয়ার প্রতিস্থাপন। এরপর অডিয়োলজিস্ট ও স্পিচ থেরাপিস্ট নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেন।
পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে বাচ্চার শোনার ক্ষমতা ফিরিয়ে না আনলে স্বাভাবিকভাবে কথা শিখতে ও বলতে অসুবিধা হয়। বাচ্চাদের পাশাপাশি বেশি বয়সেও নানা কারণে শ্রবণ ক্ষমতা লোপ পেতে পারে। চশমার মতোই হিয়ারিং এইড বা ককলিয়ার ইমপ্লান্ট জীবনের অঙ্গ করে নিলে সুস্থ জীবন যাপন করা সম্ভব।
(ঢাকাটাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন