করোনা সংক্রমিত হওয়ার শুরু থেকেই বেসরকারী হসপিটালগুলো প্রায় বন্ধ। বেসরকারী চিকিৎসকরা রোগীদের সেবা করছেন না। এনিয়ে আজ চতুর্থবারের মতো আহ্বান জানানো হলো, আশ্বস্ত করা হলো। আর এই আশ্বস্ত করলেন প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু তাদের কথায় চিকিৎসকদের মন গলবে কিনা তা দেখার বিষয়।
করোনা মোকাবেলায় ‘ফ্রন্টলাইন সোলজার’ হলেন আমাদের চিকিৎসকরা, আরো বড় করে বললে আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীরা। পৃথিবীর যে সমস্ত দেশগুলোতে করোনা মহামারি আকার ধারণ করেছে, করোনার প্রকোপ বাড়ছে- সেই সমস্ত দেশগুলোতে স্বাস্থ্যকর্মীরা সম্মুখ সমরে যুদ্ধের মতো যুদ্ধ করেছে এবং তাঁরা মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। অনেক দেশে চিকিৎসকরা তাঁদের অবসর ভেঙ্গে এই পেশায় ফিরেছেন, অনেক দেশে মানুষ স্বপ্রনোদিত হয়ে নার্স হয়েছেন এবং আত্মমানবতার সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এমনকি ভারতে চিকিৎসকরা আলাদা প্যানেল করেছেন এবং তাঁরা করোনা আক্রান্ত মানুষের সেবার জন্য নিজেদের জীবন উজাড় করে দেবার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশে অবশ্য বিষয়টি সম্পূর্ণ বিপরীত। বাংলাদেশি চিকিৎসকদের প্রতি হুমকি-অনুরোধে কাজ হচ্ছে না, শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী তাঁদের জন্য স্বাস্থ্য বীমা এবং প্রণোদনার ঘোষণা দিলেন। তাতেও লাভ হয়নি, এখন পর্যন্ত চিকিৎসকরা মাঠে নামেননি। বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা লগ আউটে গেছেন এবং সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা দায়সারা চিকিৎসা করছেন এবং ইনিয়ে বিনিয়ে নানা রকম সমস্যার কথা বলছেন। আমাদের চিকিৎসকদের এই হাল কেন? যদি চিকিৎসক নেতারা এবং চিকিৎসা সেবায় সংশ্লিষ্টরা নানা রকম ইজুহাত দিতে চাইছেন, পিপিই-এর না থাকা সহ নানা ধরণের অজুহাত তাঁরা দিতেই পারেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চিকিৎসকদের এই হাল নতুন নয়। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সবথেকে পচনশীল উপাদানটি হলো আমাদের চিকিৎসক সমাজ এবং নানা কারণেই তাঁরা পঁচে গেছেন। এই পঁচে যাবার উৎস খুঁজলে আমরা যে কারণগুলো পাই, সেগুলো হচ্ছে-
১. চিকিৎসা যেন ব্যবসা
বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে একজন চিকিৎসক হবার জন্য ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা এককালীন দিতে হয়, এরপরেও বছর প্রতি গুণতে হয় আরো টাকা। চিকিৎসা এখন একটি ব্যয়বহুল শিক্ষা মাধ্যম হয়ে গেছে, যে কারণে যারা শিক্ষা শেষ করে কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছেন, তাঁরা এটাকে মহান ব্রত বা মানবসেবার বাহন মনে না করে এটাকে মনে করছেন ব্যবসা এবং যে টাকা তাঁরা খরচ করেছেন, সেই টাকা উঠিয়ে নিতে হবে। তাই শুধু বেসরকারি চিকিৎসকরা নন, সরকারি চিকিৎসকরাও মনে করেন যে শুধু টাকা উপার্জন, গাড়ি-বাড়ি করা তাঁদের ন্যায্য অধিকার এবং এজন্য সবকিছু করার জন্যই তাঁরা প্রস্তুত। এখানেই নীতি নৈতিকতার কোন বালাই নেই, চিকিৎসক হবার পরেই তাঁরা মনে করেন যে, কিভাবে টাকা উপাজর্ন করতে হবে, কিভাবে রোগীদের পকেট কাটতে হবে। তাই চিকিৎসকরা যেন ক্রমশ বাংলাদেশে ‘কসাই’-এ রূপান্তরিত হচ্ছেন। তবে সব চিকিৎসক নয়, মুষ্টিমেয় কিছু চিকিৎসক এখনো আছেন যারা নৈতিকতা এবং মানবিকতার মানদণ্ড বজায় রেখে কাজ করছেন।
২. দলীয় রাজনীতির অন্ধকূপ
চিকিৎসকদের মধ্যে একপক্ষ হচ্ছে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ, অন্যপক্ষ হচ্ছে ড্যাব। আর সরকারি চিকিৎসক যারা আছেন তাঁরা রাজনীতি না করলে পদন্নোতি পাবেন না, উচ্চতর ডিগ্রিও এখন রাজনৈতিক চক্রে বিকিকিনি হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। যার ফলে দলীয় রাজনীতির অন্ধকূপে পড়ে চিকিৎসকরা পেশার মর্যাদা এবং পেশাগত মান হারিয়ে ফেলছেন। দলীয় আনুগত্য অর্জনই হলো তাঁদের সবথেকে বড় লক্ষ্য এবং পেশাগত দক্ষতা নয়, বরং দলীয় আনুগত্যে ভর করেই তাঁরা বহাল তবিয়তে থাকতে চান।
৩. অনৈতিকভাবে অর্থ উপার্জন
চিকিৎসকদের এখন অনৈতিকভাবে অর্থ উপার্জনের অনেক পথ রয়েছে। ফার্মাসিটিকিউল কোম্পানিগুলো এখন চিকিৎসকদের জন্য টাকার ডালি সাজিয়ে রাখে, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোও কম যায়না। যখন চিকিৎসকরা দেখেন যে, টাকা উপার্জন সহজ তখন তাঁরা নীতি নৈতিকতার বালাই ধরেন না। এই অনৈতিকভাবে অর্থ উপার্জনের কারণে চিকিৎসকরা তাঁদের পেশার যে মহত্ব এবং মানবিকতার যে দিকদর্শন- সেটাও হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে চিকিৎসকরা এখন মানব সেবার ব্রতে আর নেই।
৪. গবেষণা আর শিক্ষায় অমনোযোগ
আমাদের চিকিৎসকরা সহজলব্ধ অর্থ উপার্জনের কৌশলের কারণে তাঁদের আর গবেষণায় আগ্রহ নেই, সৃষ্টিশীলতায় আনন্দ নেই এবং চিকিৎসা পেশা নিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনেও তাঁদের অমনোযোগিতা লক্ষ্য করা যায়। ফলে তাঁরা চিকিৎসক হিসেবেও নিজেদেরকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারছেন না।
৫. চিকিৎসকদের উদ্বুদ্ধ করার অভাব
বাংলাদেশের চিকিৎসক সমাজকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য দরকার নেতৃত্ব। এক সময় বাংলাদেশে অনেক স্বনামধন্য চিকিৎসক নেতৃত্ব ছিলেন। যাদের শেষ প্রজন্ম হলেন ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ। এই সমস্ত চিকিৎসকদের মানুষ শ্রদ্ধা করতেন এবং অন্য তরুণ চিকিৎসকরা তাঁদের মতো হতে চাইতেন। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি নেই, হাতেগোনা যে দু-চারজন মানবসেবার আদর্শ চিকিৎসক আছেন তাঁরা এখন বার্ধক্যের কোঠায় আর নতুন যারা আসছেন তাঁরা মনে করছেন যে, মানবসেবা করে কি হবে, তাঁর থেকে অর্থ উপার্জনই ভালো।
আর এই কারণে বর্তমানে চিকিৎসা সেবার এই হাল। করোনার মতো এই সঙ্কটেও তাঁদেরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন