মৌসুমী ফ্লুর বৈশিষ্ট্যই হলো শীতকালে প্রাদুর্ভাব বাড়বে, বসন্ত এলে ক্রমেই প্রশমিত হবে। নতুন করোনাভাইরাস জনিত কভিড-১৯ এর ক্ষেত্রেও কি এ নিয়ম খাটবে? গরম পড়লেই সারা বিশ্ব থেকে এ মহামারি উধাও হয়ে যাবে? মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কিন্তু এরই মধ্যে বলেছেন, এপ্রিলের রোদ করোনার দাপট কমিয়ে দেবে। তবে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাপারটা অতো সরল নয়। কারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রকোপ বাড়ে মূলত মৌসুম পরিবর্তনের কারণে। তাই বলে শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ ঘটানো সব ধরনের ভাইরাস একই আচরণ করবে এটা বলা যায় না।
আবহাওয়া প্রভাব কতোটা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ নিয়ে কথা বলার সময় এখনো আসেনি। নতুন করোনাভাইরাস সৃষ্ট কভিড ১৯ শ্বাসতন্ত্রের রোগটিতে এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বে ১ লাখ ২০ হাজার তারও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। তবে এর বেশিরভাগই কিন্তু চীনে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, গরম পড়লে এ ভাইরাসের ধার কমবে এটা বলার কোনো কারণে নেই। তবে বিষয়টি যাচাই করে দেখার দাবি করে।
প্রমাণ আছে কি
ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব প্রশমনে আবহওয়ার প্রভাব নিয়ে খুব কম গবেষণা হয়েছে। তবে একটিও এখন পর্যন্ত স্বীকৃত বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের বেশ কয়েকজন গবেষক বলছেন, কভিড-১৯ সংক্রমণ এখন পর্যন্ত কয়েকটি অঞ্চলের মধ্যেই সীমিত। এর মধ্যে অন্যতম চীনের উহান, ইতালির মিলান এবং যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল। এই শহরগুলোর আবহাওয়া মোটামুটি একই রকম। যেমন, শীতকালে কিছুটা আর্দ্র এবং তাপমাত্রা ৫ -১১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। তুলনামূলক উষ্ণ অঞ্চল যেমন ব্যাংককে যারা আক্রান্ত হয়েছে তারা প্রায় সবাই বাইরে থেকে এসেছেন, এবং এসব এলাকায় এ ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়েও পড়েনি। তবে এ ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গেই দেয়া উচিত বলে মনে করেন তারা।
ফ্লুর সঙ্গে আবহাওয়া কী সম্পর্ক
নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে ফ্লু মূলত শীতকালের সমস্যা। গ্রীষ্মপ্রধান ও প্রায় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে ফ্লু হয় সাধারণত বর্ষকালে। ফ্লুর ক্ষেত্রে এই ঋতুভেদের কারণ ব্যাখ্যায় নানা তত্ত্ব রয়েছে। দেখা গেছে, ঠাণ্ডা, শুষ্ক বাতাস এবং আর্দ্র পরিবেশ ফ্লুর বিস্তারে উপযুক্ত। শীত ও বর্ষাকালে যেহেতু মানুষ বেশিরভাগ সময় ঘরে থাকে ফলে তারা ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে বেশি আসে। তখন একে অপরের কাছ থেকে সংক্রমিত হয়। কিন্তু আবহাওয়া সুন্দর আরামদায়ক হলে মানুষ বাইরে বেশি ঘোরাফেরা করে। তখন স্বাভাবিকভাবেই পারস্পরিক ভাইরাস দূষণ কমে যায়। এছাড়া গ্রীষ্মকালে মানুষের শরীরে মেলাটনিন এবং ভিটামিন ডি এর মাত্রা বেড়ে যায়। এ উপাদানগুলো শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। উপরন্তু গরমকালে ভাইরাসের শরীরের ফ্যাট প্রাচীর ক্ষয়ে যায়, এতে তাদের সংক্রমণ ক্ষমতা কমে যায়।
সার্সের ক্ষেত্রে কী ঘটেছিল
২০০২-০৩ সালে আরেক করোনা ভাইরাসের মহামারি দেখা দিয়েছিল। সেটি হলো সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম বা সার্স। এ রোগের প্রাদুর্ভাবও শুরু হয়েছিল শীতকালে এবং গরম পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমে গেছে। তাহলে সার্স ভাইরাসের ওপর আবহাওয়ার কি প্রভাব পড়বে? এর উত্তরে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির এপিডেমিওলজির অধ্যাপক মার্ক লিপস্টিচ জানান, সার্স কিন্তু প্রাকৃতিক কারণে ধ্বংস হয়নি। চীনের মূল ভূখণ্ড, হংকং, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, কানাডা এবং অন্যান্য অঞ্চলে ব্যাপক স্বাস্থ্য সচেতনতা অবলম্বনের কারণেই এটিকে দ্রুত বশে আনা গিয়েছিল। নানা ব্যবস্থার পাশাপাশি কর্তৃপক্ষ আক্রান্তকে আইসোলেশনে নেয়া এবং সন্দেহজনকদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছিল। এ কৌশল বেশ কাজে দিয়েছে। কারণ সার্স আক্রান্তদের মধ্যে স্পষ্ট লক্ষণ দেখা যায়। চীন এখন ওই কৌশলই নিয়েছে। তবে এ ভাইরাসের দীর্ঘ সুপ্তাবস্থা এবং প্রচুর মানুষের মধ্যে মৃদু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, এ কারণে এখনকার পরিস্থিতি বেশ জটিল।
এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, নতুন করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার ১-২ শতাংশ। যেখানে শীতকালীন ইনফ্লুয়েঞ্জায় মৃত্যুর হার দশমিক ১ শতাংশ। তাছাড়া এ করোনা ভাইরাস ফ্লুর মতোই সংক্রমণ ঘটায়, তবে বেশি মারাত্মক। কারণ এটির কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা বা মৌসুমী ভ্যাকসিন নেই।
উহান, মিলান, সিয়াটলের যেসব এলাকায় বেশি প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে সেসব এলাকার উপাত্ত ব্যবহার করে বিশ্লেষণ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের গবেষকরা। তারা বলছেন, বিশ্বের নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় করোনা প্রাদুর্ভাব আসন্ন। একটি নির্দিষ্ট ধরনের আবহাওয়া ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে সহায়তা করতে পারে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একই গড় তাপমাত্রা, আপেক্ষিক আর্দ্রতা এবং অক্ষাংশে অবস্থিত অঞ্চলে নতুন করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের চিত্রটা মোটামুটি একই রকম। বিশেষ করে অন্তত একমাস একই আবহাওয়া বিরাজ করে এমন এলাকার মধ্যে মিল বেশি।
নিউইয়র্কের সিরাকিউস ইউনিভার্সিটির জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ব্রিটানি কেমশ বলেন, মানুষের হয় এমন ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং অন্যান্য করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মৌসুমের ওপর নির্ভর করে। দেখা যায়, উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত দেশগুলোতে শীতকালে এটি বেশি হয়। তবে নতুন করোনাভাইরাস এই প্যাটার্ন মেনে চলবে কিনা বলা কঠিন।
গ্রীষ্মে ফ্লুর ভাইরাস কি উধাও হয়ে যাবে
গরম পড়লে ফ্লুর প্রাদুর্ভাব কমে আসবে মানে এই নয় যে, এ ভাইরাস মারা যাবে। বরং এটি সহজে ছড়িয়ে পড়তে পারবে না এই যা। ফলে গ্রীষ্মকালে নতুন করোনাভাইরাস সংক্রমণ কমে গেলেও আসছে বর্ষায় আবার ফিরে আসতে পারে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন