জটিল রোগের নকল ওষুধ সারা দেশে ৯৩ শতাংশ ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের কাঁচামালের গোপন বাজার।
বাজার ছেয়ে গেছে ক্যান্সার, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন জটিল রোগের নকল ওষুধে। এসব ওষুধ পরখ করতে ভোক্তা কেন, হিমশিম খেতে হয় খোদ ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের কর্মকর্তাদেরও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি চক্রের মাধ্যমে এসব নকল, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধই ছড়িয়ে পড়ছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ওষুধের দোকানে। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে অতি প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম নিজেদের মতো করে বাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর ও র্যাবের তথ্য মতে, রাজধানীর ৯৩ শতাংশ ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধও বিক্রি হচ্ছে। আর সারা দেশে এমন ফার্মেসির সংখ্যা আরও বেশি হবে। এসব ফার্মেসি থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ কিনে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন ভোক্তারা। পড়ছেন মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গত ১২ মে পর্যন্ত নকল ওষুধ ও ভুয়া চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ৩৩টি অভিযান পরিচালনা করেছে র্যাব। এ সময় ১৪৪টি মামলা হয়। ৭৮ জনকে জেল এবং ৭০ লাখ ৪৩ হাজার ৭০০ টাকা জরিমানা করা হয়। গত বছর ৯৮টি অভিযানে ২৯৩টি মামলা হয়। ২২৭ জনকে জেল এবং ৪৩ কোটি ১২ লাখ এক হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার জানান, নিয়মিত বাজার তদারকির এক বছরের রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ঢাকা শহরের প্রায় ৯৩ শতাংশ ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, গত ৫ মার্চ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের অভিযানকালে রাজধানীর ধানমন্ডি ও শাহজাহানপুর থানার কিয়োর ফার্মেসিকে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রর অভিযোগে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। একই এলাকার প্যানকেয়ার মেডিসিন কর্নারকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। ৭ মার্চ শ্যামলীতে মেয়াদোত্তীর্ণ ও ভেজাল ওষুধ বিক্রির অভিযোগে চারটি ফার্মেসিকে ৬৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। ৯ মার্চ মুগদা এলাকার ভোলা ড্রাগ হাউস, ঢাকা ড্রাগ হাউস এবং রানা ফার্মেসিকে ৩০ হাজার টাকা করে ৯০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। ১১ মার্চ বনানী এলাকায় বেস্ট ফার্মাকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এই অপরাধে গত ১২ মার্চ খিলক্ষেতের সিয়াম ফার্মেসিকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। অসাধু বিক্রেতারা অনেক সময় মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের গায়ে নতুন করে মেয়াদ সংবলিত স্টিকার লাগিয়ে তা বিক্রি করে। নতুন স্টিকার উঠিয়ে দেখা গেছে, ২০১৮ সালে যে ওষুধের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, সে ওষুধে ২০২০ পর্যন্ত মেয়াদ লাগানো হয়েছে। তাছাড়া অনেক সময় বিদেশ থেকে আমদানি করা ওষুধের প্যাকেটে কোনো ধরনের উৎপাদন তারিখ বা মেয়াদের তারিখ থাকে না।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের হিসাবে, নকল ওষুধের বিরুদ্ধে গত বছর মোট মামলা হয় এক হাজার ৫৫৭টি। এ সময় ২২ কোটি ৬৮ লাখ এক হাজার ৬৬০ টাকা জরিমানা এবং ৩৪ জনকে জেল দেওয়া হয়। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ১৮৯টি মামলা হয়েছে। জরিমানা করা হয়েছে ১৯ লাখ ৬৮ হাজার ৮১৪ টাকা এবং ৫ কারখানা সিলগালা করা হয়। এ ছাড়া গত ২৫ এপ্রিল ২৮টি কোম্পানির ৬৮টি ওষুধের নিবন্ধন সাময়িকভাবে বাতিল করে সংস্থাটি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নকল ও ভেজাল ওষুধ খেয়ে সুস্থ হওয়ার বদলে মানুষের শরীরে বাসা বাঁধছে নানারকম রোগ। কঠোর মনিটরিং এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া ভেজালকারীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করা সম্ভব নয়। প্রয়োজনে মনিটরিংয়ের জন্য অভিজ্ঞতা সম্পন্ন দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।
তারা আরও বলছেন, অনেক প্রতিষ্ঠিত ওষুধ কোম্পানির মালিকেরা তাদের নিজের কারখানায় উৎপদিত ওষুধ ব্যবহার করেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। তারা নিজেরাই যদি নিজেদের কোম্পানির ওষুধ ব্যবহার না করেন তাহলে তো ওষুধের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সার্জারি বিভাগের এক চিকিৎসক এ প্রতিবেদককে বলেন, মাঝে মাঝেই আমরা ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে ভয়ঙ্কর সমস্যার মুখোমুখি হই। অপারেশনের আগে এনেসথেসিয়ায় ব্যবহৃত ইফিড্রিন, প্যাথিড্রিন, আলট্রাকেইন হেভি’র মতো ওষুধগুলো কাজ করে না। আবার সার্জারিতে ব্যবহৃত নিম্নমানের সুতায় ছেয়ে গেছে বাজার। অথচ দাম অনেক চড়া। এসব বিষয়ে কঠোর মনিটরিংয়ের দাবি তার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, পুরান ঢাকা ও কেরানীগঞ্জে ওষুধ নকল চক্রের ১০-১২ জন সক্রিয় সদস্য রয়েছে। এরা ওষুধ তৈরিতে পারদর্শী। বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানিতে অনিয়মের কারণে চাকরিচ্যুত হয়ে নিজেরা শুরু করেছে নকল ওষুধ উৎপাদন। লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর এবং কেরানীগঞ্জে বিভিন্ন ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে নকল ওষুধ তৈরি করে তা মিটফোর্ডের কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা দেশে। গত ২ ফেব্রুয়ারি গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ওষুধ নকলকারী একটি চক্রের হোতা আবদুস সোবহানসহ পাঁচজনকে যাত্রাবাড়ী থেকে গ্রেফতার করে। আবদুস সোবহান একটি ওষুধ কোম্পানি থেকে চাকরিচ্যুত হয়। পরে সে আরও কয়েকজনকে নিয়ে নকল ওষুধ তৈরি শুরু করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ইনসুলিন, প্যাথেডিনসহ বিভিন্ন ওষুধের হুবহু নকল ওষুধ। গত বছরের ৫ নভেম্বর পুরান ঢাকার মিটফোর্ড টাওয়ার ও হাবিব মার্কেটে অভিযান চালিয়ে ক্যান্সারের ওষুধ, ইনসুলিন, হৃদরোগের ওষুধসহ দুই কোটি টাকার নকল ও ভেজাল ওষুধ জব্দ করে র্যাব। গত ১ আগস্ট একই এলাকা থেকে ২০ কোটি টাকার নকল ও সরকারি ওষুধ জব্দ করা হয়। এ সময় ৫০টি ফার্মেসিকে ৬০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। গত ২৪ জুলাই মিটফোর্ডে ৩২টি দোকানকে ৫৪ লাখ টাকা জরিমানা ও ৬ মালিককে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ দেয় র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। গত ৮ মে মিটফোর্ড এলাকায় ১৫ কোটি টাকার নকল ওষুধ জব্দ এবং পাঁচজনকে দুই বছর করে কারাদ দেওয়া হয়। ২০১৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর তাঁতীবাজার থেকে ক্যান্সার ও বিভিন্ন জটিল রোগের ৪০ হাজার পাতা নকল ওষুধসহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। তারা চীন থেকে নকল ওষুধ তৈরি করে এনে দেশে বাজারজাত করত।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, বিশ্বের মোট ওষুধ উৎপাদনের ১০ শতাংশ হলো নকল ও ভেজাল ওষুধ। উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশেষ করে এশিয়ার দেশগুলোতে নকল-ভেজাল ওষুধের অপ্রতিরোধ্য দৌরাত্ম্য চলছে। এসব দেশে নকল ওষুধ উৎপাদনের কারখানা রয়েছে। রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নকল ও ভেজাল ওষুধকে ছয় ভাগে ভাগ করে। ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার (ক্রাইম) শেখ নাজমুল আলম বলেন, মাঝে মাঝেই আমরা অভিযোগ পাই ওষুধে কাজ করে না। হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানি ছাড়া বেশিরভাগ কোম্পানির ওষুধ নিম্নমানের এটা অনেকেই জানেন। তবে বিষয়টি তো আমাদের এখতিয়ারভুক্ত নয়। এ জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কোনো অভিযানে তারা আমাদের সহায়তা চাইলেই আমরা সাড়া দেই। এ ছাড়া সুনির্দিষ্ট কিছু তথ্যের ভিত্তিতে আমরা অভিযান পরিচালনা করে অনেক ভেজাল ওষুধের কারখানাসহ বিপুল পরিমাণ ওষুধ জব্দ করেছি। অপরাধীদেরও আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। নিজের অভিজ্ঞতার বিষয়টি উল্লেখ করে এ প্রতিবেদককে বলেন, দেখুন গত এক বছর ধরে আমার নিজেরই হাইপ্রেসারের মারাত্মক সমস্যা ছিল। গত মার্চে ভারতে চিকিৎসা নেওয়ার পর থেকে আমার আর এই সমস্যা নেই। তবে সেখানকার চিকিৎসকরা আমাকে ওই দেশ থেকেই ওষুধ কিনে আনতে পরামর্শ দিয়েছেন।
নিয়ন্ত্রণহীন দেশের ওষুধের বাজার : ১১৭টি ওষুধ ছাড়া বাকিগুলোর ওপর ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় কারণে-অকারণে ওষুধের দাম বাড়িয়ে নিচ্ছে ওষুধ কোম্পানিগুলো। আর এই নির্যাতন সহ্য করতে হচ্ছে রোগী ও তাদের স্বজনদের। গত মার্চে রাজবাড়ীতে ১২ টাকা মূল্যের একটি ইনজেকশন ৮০০ টাকায় বিক্রির ঘটনা ঘটে। অস্ত্রোপচারে ব্যবহৃত সেলাই সুতার দাম ১৫-২০ টাকা। গত ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর শাহবাগে একটি ওষুধের দোকানে অস্ত্রোপচারে ব্যবহৃত সেলাই সুতা কিনতে যান দেলোয়ার হোসেন নামে এক ব্যক্তি। তার কাছে এই সুতার দাম নেওয়া হয় ৬০০ টাকা। গত বছরের ডিসেম্বরে যশোরে একটি দোকানে অ্যাপোনসেট নামের বমির ওষুধ কিনতে গেলে দাম রাখা হয় ১ হাজার ৯০০ টাকা। অথচ ওষুধের প্রকৃত দাম মাত্র ৬০ টাকা। এ ধরনের ঘটনা দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা-উপজেলায় প্রতিনিয়ত ঘটছে। ক্যান্সার চিকিৎসায় কেমোথেরাপিতে প্রয়োজনীয় ডসেটিক্সেল, প্যাক্লিটেক্সেল, কার্বোপ্লাটিন, সিসপ্লাটিন, জেমসিটাবিন ইত্যাদি ওষুধের দাম ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ক্যাটামিন ইনজেকশনের দাম ৮০-১১৫ টাকা কিন্তু বিক্রি হয় ২০০-২৫০ টাকায়। তবে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক রুহুল আমীন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঢাকা জেলায় একজন সহকারী পরিচালকের নেতৃত্বে আমাদের ৫টি টিম নিয়মিতভাবে বাজার মনিটরিং এবং ওষুধের কারখানা ভিজিট করে। আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী সর্বোচ্চ কাজই করে আসছি। সম্প্রতি ২৮টি কোম্পানির উৎপাদিত ৬৮টি ওষুধ নিম্নমানের হওয়ায় এর রেজিস্ট্রেশন সাময়িক বাতিল করা হয়েছে।
ওষুধ কাঁচামালের গোপন বাজার : কঠোর গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে ওষুধ তৈরির বিভিন্ন কাঁচামাল বিক্রি হয় পুরান ঢাকার মিটফোর্ড রোডের কেমিক্যালের দোকানগুলোতে। এসব দোকান থেকে কাঁচামাল কিনে নিয়ে যায় সংঘবদ্ধ বিভিন্ন চক্র। এমোক্সাসিলিন, ডাইক্লোফেনাক সোডিয়াম, মেট্রো, ফ্লুক্লোনাজল, সিফিকজিম, সিপরো, রেনিটিডিনের মতো ওষুধ তৈরির গুরুত্বপূর্ণ কেমিক্যাল গোপনে বিক্রি হয়।
অথচ জাতীয় ওষুধ নীতিমালা-২০১৬ অনুযায়ী খোলাবাজারে ওষুধের কেমিক্যাল বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
নকল ওষুধ চেনার উপায় : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী, নকল ওষুধ চিনতে সিরাপ, টনিক বা ওই জাতীয় বোতলজাত ওষুধের ক্ষেত্রে ওষুধের বোতলে সিল বা প্যাকেজিং-এ কোথাও কোনো গলদ (মোড়কের রং, আকার-আকৃতি, বানান ইত্যাদি সবই দেখে নিতে হবে) আছে কি-না, প্রথমেই তা ভালো করে দেখে নিতে হবে। বড়ি, ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল জাতীয় ওষুধের ক্ষেত্রে ওষুধের কোথাও কোনো অংশ ভাঙা রয়েছে কি-না, স্বচ্ছ ক্যাপসুলের ভিতরে থাকা ওষুধের গুঁড়ার পরিমাণ আগের তুলনায় কম বা বেশি আছে কি-না, ওষুধের রঙে কোনো ফারাক রয়েছে কি-না তা ভালো করে দেখে নিতে হবে। যে কোনো ওষুধের মোড়কের গায়ে তার ‘ইউনিক অথেনটিকেশন কোড’ লেখা থাকে। ওষুধ কেনার পর সেটির সম্পর্কে মনে কোনো রকম সন্দেহ দানা বাঁধলে, ওষুধের ‘ইউনিক অথেনটিকেশন কোড’ ৯৯০১০৯৯০১০ নম্বরে এসএমএস করুন। ওই ওষুধটি যেখানে তৈরি, সেখান থেকে একটি অথেনটিকেশন মেসেজ পাওয়া যাবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন