ডাউন সিনড্রোম একটি বিশেষ ধরণের জেনেটিক বা জিনগত অবস্থা। ডাউন সিনড্রোম নিয়ে জন্ম নেয়া মানুষের ক্রোমোজোমের গঠন সাধারণ মানুষের ক্রোমোজমের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন হয়ে থাকে।
এর কারণে মানুষের মধ্যে মৃদু বা মাঝারি স্তরের বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যা, বেড়ে ওঠায় বিলম্ব বা অন্য কিছু শারীরিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। বাংলাদেশে এই বিশেষ ধরণের শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত মানুষের জন্য আলাদাভাবে কোনো ধরণের সহায়তার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।
ডাউন সিনড্রোমে ভুগতে থাকা ব্যক্তিদের সহায়তা দেবার উদ্দেশ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৬ সালে গঠিত হয় বাংলাদেশ ডাউন সিনড্রোম সোসাইটি।
সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সরদার রাজ্জাক জানান, এর শুরুটা হয় ২০১০ সালে ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুদের অভিভাবকদের নিয়ে তৈরী করা একটি সংগঠনের (প্যারেন্টস সাপোর্ট গ্রুপ) মাধ্যমে।
রাজ্জাক বলেন, ‘২০১০’এ প্যারেন্টস সাপোর্ট গ্রুপের মাধ্যমে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। শুরু করার পর আস্তে আস্তে বিভিন্ন জায়গা থেকে অভিভাবকেরা আমাদের জানাতে শুরু করে তাদের সন্তানদের ডাউন সিনড্রোমের কাহিনী’।
রাজ্জাক জানান, ২০১৪ সালের ২১শে মার্চ ডাউন সিনড্রোম সোসাইটির উদ্যোগে প্রথমবারের মত বাংলাদেশে বিশ্ব ডাউন সিনড্রোম দিবস পালন করা হয়। তবে তা সরকারি স্বীকৃতি পায় ২০১৭ সালে এসে। সেবছরই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ও গবেষণার সাথে যুক্ত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ডাউন সিনড্রোমের লক্ষণ কী?
বাংলাদেশে ডাউন সিনড্রোমের জন্য আলাদা কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই বলে জানান মনোরোগবিদ মেখলা সরকার। সেরেব্রাল পালসি বা মস্তিষ্কে পক্ষাঘাতজনিত সমস্যা, ইন্টেলেকচুয়াল ডিজঅর্ডার বা বুদ্ধিগত সমস্যা এবং ডাউন সিনড্রোমকে একই ধারায় বিচার করা হয় বলে জানান সরকার।
ডাউন সিনড্রোমের বাহ্যিক লক্ষণগুলো হলো:
নতুন কিছু শেখার ক্ষেত্রে সাধারন মানুষের চেয়ে ধীরগতির হয়ে থাকে। কিন্তু সাধারনত দ্রুত অনুকরণ করতে সক্ষম। অনেকের শারীরিক কিছু উপসর্গ দেখা যায়। চোখ, জিহ্বা, কান ও পায়ের পাতা কিছুটা অস্বাভাবিক হতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে হৃদরোগ বা পাকস্থলিতে সমস্যাও দেখা যায়।
ডাউন সিনড্রোমের পাশাপাশি অন্যান্য মানসিক সমস্যাও (অনেক সময় সেরেব্রাল পালসি) তৈরী হতে পারে। সাধারণ মানুষের আলঝেইমার্স ডিজিজ বা স্মৃতিভ্রম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ৬৫ বছর বয়সের পর, তবে ডাউন সিনড্রোমে আক্রন্তদের ৪০ বছর বয়সের পরই এই সম্ভাবনা তৈরী হয়।
ডাউন সিনড্রোম আর অটিজম কি এক?
সরকার জানান বাংলাদেশে ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা খুব বেশী নেই বলেই তাদের অন্যান্য মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদের সাথে একই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করার প্রবণতা বেশী। কিন্তু ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত মানেই যে অটিজমের শিকার, তেমনটিও সবসময় সত্যি নয়।
অটিজম প্রকৃতপক্ষে স্নায়ুতন্ত্র সংক্রান্ত একটি সমস্যা এবং এতে আক্রান্ত ব্যক্তির সাধারণত বাহ্যিক শারীরিক কোন বৈশিষ্ট্য দেখা যায় না। ডাউন সিনড্রোম আক্রান্ত ব্যক্তিদের অন্যান্য মানসিক প্রতিবন্ধী হিসেবেই বিবেচনা করা হয় বলে জানান সরদার রাজ্জাক।
তবে রাজ্জাক জানান, ‘ডাউন সিনড্রোমে আক্রন্তদের মস্তিষ্কে কোনো সমস্যা থাকে না। কিন্তু বাংলাদেশে প্রথাগত ধারা অনুযায়ী সব ধরণের মানসিক সমস্যায় ভুগতে থাকা মানুষকে একই কাতারে যাচাই করা হয়’।
বিশ্বে প্রতি এক হাজার জন্ম নেয়া শিশুর মধ্যে একজনের ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে
বাংলাদেশের সমাজে ডাউন সিনড্রোমকে কীভাবে দেখা হয়?
রাজ্জাকের মতে ডাউন সিনড্রোমে ভুগতে থাকা ব্যক্তিরা মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ। তাদের পরিবারের মানুষজনের সমর্থন ও সহায়তা পেলে ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সহজেই সমাজের নাগরিক হিসেবে জীবনযাপন করতে পারেন।
‘ডাউন সিনড্রোমে ভুগতে থাকা শিশুরা গতানুগতিক স্কুলে গেলেও অনেকসময় সহ-শিক্ষার্থীদের বা তাদের বাবা-মা’র বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হন। সহ-শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের ভুল ধারণার জন্যই এমনটা ঘটে থাকে’।
তবে শহরাঞ্চলে ধীরে ধীরে ডাউন সিনড্রোম সম্পর্কে সচেতনতা তৈরী হলেও, শহরের বাইরে এখনও এবিষয়ে প্রচুর সচেতনতা তৈরী প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন রাজ্জাক।
রাজ্জাক জানান, ডাউন সিনড্রোম সোসাইটির অধীনে ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সহায়তার উদ্দেশ্যে অভিভাবকদের সংগঠনের পাশাপাশি আক্রান্তদের ভাই-বোনদের নিয়েও বিশেষ সাপোর্ট গ্রুপ তৈরী করা হয়েছে। ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিরা যেন তাদের সহোদরদের কাছ থেকে মানসিক সহায়তা ও সাহস পায় তা নিশ্চিত করতেই এই প্রচেষ্টা।
ডাউন সিনড্রোম সোসাইটিকে এ বিষয়ে গবেষণায় সহায়তা করবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল এবং কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন