রাজপথে সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে কারাবন্দি হয়েছেন বিএনপির কয়েক হাজার নেতাকর্মী। আর মামলা হয়েছে কয়েক লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মামলা হয়েছে রাষ্ট্রীয় কাজে বাধাদান ও নাশকতার অভিযোগে। বিএনপির আশা ছিল নির্বাচনের পর মুক্তি পাবে দলের আটক নেতাকর্মীরা। তবে সরকার দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন নির্বিঘ্নে শেষ করলেও এখনও মুক্তি মিলছে না দলটির সিনিয়র নেতারা। তবে, মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা মুক্তি পেতে শুরু করেছেন।
এক মামলায় জামিন মিললে অন্য মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে আটককৃত সিনিয়র নেতাদের। বিশেষ করে ২৮ অক্টোবরের পুলিশ হত্যা ও প্রধানমন্ত্রী বিচারপতির বাসভবনে হামলার মামলায় জামিন পাচ্ছেন না তারা। তাদের আইনজীবীরা বলছেন, একই মামলায় অনেককে জামিন দেওয়া হলেও বিএনপির সিনিয়র ও প্রবীণ নেতাদের জামিন নাকচ করা হচ্ছে।
সিনিয়র নেতাদের মুক্তি না পাওয়া প্রসঙ্গে দলটির নেতারা বলছেন, সরকার গায়ের জোরে নির্বাচন করেছে। আওয়ামী লীগ জানে তাদের পতন যে কোনো সময়ে অনিবার্য। তাই ক্ষমতাচ্যুতির ভয়ে সিনিয়র নেতাদের জামিন দিচ্ছে না। তারা বলছেন, একই মামলায় আসামি হয়ে ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর আজ এমপি। আর বিএনপি নেতারা অন্ধকার কারাগারে।
এ বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ঢাকা টাইমসকে বলেন, সরকার নানা ধরনের স্কিম নিয়ে কাজ করছে। তাদের উদ্দেশ্য হলো দমন-পীড়ন করে বিরোধী মতকে স্তব্ধ করে দেওয়া। তাই সরকার মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের জামিন দিলেও শীর্ষনেতাদের দিচ্ছে না। তারা শঙ্কা থেকে এগুলো করছে। তারা যেহেতু জালিয়াতি করে একতরফা ডামি নির্বাচন করেছে, তাই তারা আতংকগ্রস্ত যেকোনো সময় তাদের অবৈধ ক্ষমতা জনগণ বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেবে।
দলটির তৃণমূল থেকে শুরু করে একেবারে হাইকমান্ড পর্যন্ত প্রায় সবার বিরুদ্ধেই মামলার পাহাড়। এর মধ্যে প্রায় দেড় হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সম্প্রতি সাজার রায় ঘোষণা করেছেন আদালত। নিয়মিত মামলার সঙ্গে এখন সাজার দণ্ড মাথায় নিয়ে ফেরারি জীবন পার করছেন অসংখ্য নেতাকর্মী।
নির্বাচনের পরও ৩০ জানুয়ারি সারা দেশে কালো পতাকা মিছিল কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে শতাধিক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় দলটির মধ্যে আবার কিছুটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
নির্বাচনের আগেই প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার মামলায় আগাম জামিন পেয়েছেন বিএনপির তিন নেতা ও সুপ্রিম কোর্টের জৈষ্ঠ আইনজীবী হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন পেয়েছেন। তারা হলেন-বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী ও যুগ্ম মহাসচিব এএম মাহবুবউদ্দিন খোকন।
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এবং ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু জামিনে মুক্তি পেয়ে আন্দোলনের মাঠে নেমেছেন। এই মামলায় জামিন পেয়েছেন জাতীয় দলের চেয়ারম্যান, ১২দলীয় জোটের সমন্বয়ক সৈয়দ এহসানুল হুদাও। ২৮ অক্টোবরের পর বিভিন্ন সময়ে আত্মগোপন থেকে বের হয়ে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত হঠাৎ হঠাৎ ঝটিকা মিছিল ও লিফলেট বিতরণ করেছেন দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। এখন তিনিও প্রায় প্রতিদিনই নয়াপল্টন কার্যালয়ে আসছেন।
২৮ অক্টোবরের পর শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ছাড়াও আরো গ্রেপ্তার হোন ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী, শামসুজ্জামান দুদু, যুগ্ম মহাসচিব মজিবুর রহমান সরোয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব ও আতাউর রহমান ঢালী, সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক সালাহ উদ্দিন আহমেদ, সমাজ কল্যাণবিষয়ক সম্পাদক কাজী আবুল বাশার, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্যসচিব আমিনুল হক, মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন, নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু সাঈদ চাঁদ, সাইয়েদুল আলম বাবুল, শেখ রবিউল আলম রবি, আবুল হোসেন খান ও ফজলুর রহমান খোকন উল্লেখযোগ্য। এখন পর্যন্ত এদের কারো মুক্তি মিলেনি। এরআগে আটক হোন ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম পিন্টু, যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী, ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, দক্ষিণের সদস্যসচিব রফিকুল ইসলাম মজনু, সাবেক সংসদ সদস্য মিয়া নুরুদ্দীন অপু, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নীরব, যুবদল সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মোনায়েম মুন্নাসহ অনেক নেতা।
অন্যদিকে, গ্রেপ্তারের ভয়ে আত্মগোপনে চলে যান কেন্দ্রীয় কমিটির পদধারী বেশিরভাগ নেতা। তবে তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি অনেকেরই। পুলিশের চিরুনি অভিযানে কারাবরণ করতে হয়েছে দলের ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের অসংখ্য নেতাকর্মীকে।
২৮ অক্টোবরের সহিংসতায় পুলিশ হত্যা ও প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলায় দায়েরকৃত মামলায় হুলিয়া নিয়ে সক্রিয় নেতাদের মধ্যে এখনও ফেরারী জীবন-যাপন করছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আব্দুস সালাম, ঢাকা মহানগর উত্তরের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক অধ্যাপক ফরহাদ হালিম ডোনার, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল, ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল, বিএনপিরসহ স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল কাদির ভূইয়া জুয়েল, বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন, যুবদলে সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এসএম জিলানী, সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান, কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুল, ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক একরামুল হাসান, ইকবাল হাসান শ্যামল, যুবদলের সিনিয়রসহ সভাপতি মামুন হাসান, সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার, ঢাকা মহানগর উত্তরের আহবায়ক রবিউল ইসলাম নয়ন, দক্ষিণের আহবায়ক শরীফ উদ্দিন জুয়েলসহ অসংখ্য নেতাকর্মী।
২৮ অক্টোবরের পর থেকে সিনিয়রদের মধ্যে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান এবং সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী রাজপথে ছিলেন সক্রিয়। নির্বাচনে এক সপ্তাহ আগে লিফলেট বিতরণ কর্মসূচিতে দেখা মিলে অপর দুই স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান এবং সেলিমা রহমানের।
বিএনপির তথ্য অনুযায়ী, ২৮ অক্টোবরের কয়েক দিন আগে-পরে থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত প্রায় ‘৮০০ মামলায় বিএনপির ২৬ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত ২৮ অক্টোবরের পর তিন মাসে কারাগারেই ৯ জন মারা গেছেন। কারা কর্তৃপক্ষের দাবি, ‘অসুস্থতাজনিত’ কারণে মৃত্যু হয়েছে তাদের। অন্যদিকে পরিবারের অভিযোগ, নির্যাতন ও সুচিকিৎসা না পাওয়ায় এই করুণ পরিণতি।
ইতোমধ্যে বিএনপি মধ্য ও জেলা-উপজেলা পর্যায়ের অনেক নেতাকর্মী জামিনে মুক্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাবেক সংসদ সদস্য ও বরিশাল দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবুল হোসেন খান, সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, সহ-স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম বাচ্চু, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সদস্যসচিব তানভীর আহমেদ রবিন, বিএনপির কেন্দ্রীয় সমবায় বিষয়ক সম্পাদক ও হবিগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র জি কে গউছ। গাজীপুর জেলার বাসন থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. মনিরুল ইসলাম মনির, বাসন থানা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. মিলন হোসেন, সদস্য এসএম শামীম, মো. রবিউল ইসলাম, বাসন থানাধীন ১৫ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য মোশারফ হোসেন, নরসিংদী জেলা বিএনপির সদস্য সচিব মঞ্জুর এলাহী।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, সরকার বিএনপিকে সবসময়ই ভয় পায়। তারা বিএনপিকে আতংক মনে করছে। তারা মনে করছে সিনিয়র নেতাদের বন্দী রাখলে আন্দোলনের ছক তৈরি করতে পারবে না। সরকার রাজনীতিটাকে খেলা হিসেবে নিয়েছে। তারা তাদের খেলা খেলতে থাকুক। আমরা আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই আমাদের সিনিয়র নেতাদের মুক্ত করবো।
ঢাকাটাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন