আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না- অনড় অবস্থানে বিএনপি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বলছে, সংবিধানের বাইরে একচুলও যাওয়া যাবে না। অর্থাৎ ক্ষমতাসীন এ দলের অধীনেই হবে নির্বাচন। দেশের বড় দুই দলের এমন দুই মেরুতে অবস্থানের মধ্যেই এগিয়ে আসছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ফলে আগামীর এ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে কি না- এ নিয়ে রয়েছে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে বসে নেই বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা, বিশেষ করে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো। সংকট থেকে উত্তরণ তথা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে বড় দুই দলের মধ্যে আলোচনার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা। সূত্রে প্রাপ্ত সর্বশেষ তথ্য বলছে, সংকট সমাধানে আগামী মাস থেকে গতি পেতে পারে কূটনৈতিক উদ্যোগ। সেক্ষেত্রে খুলে যেতে পারে আলোচনার দুয়ার। সংশ্লিষ্ট কূটনীতিকরা মনে করছেন, দুই পক্ষের গ্রহণযোগ্য একটি সমাধানে আসার ক্ষেত্রে আলোচনার বিকল্প নেই।
এদিকে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের একদফা ইস্যুতে যে কোনো আলোচনার প্রস্তাবকে স্বাগত জানাবে, বলছে বিএনপি। কিন্তু সংলাপ বা আলোচনার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন খোদ আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ১৫ মে সংবাদ সম্মেলনেও তিনি বলেছেন, সংসদ সদস্য যারা আছেন, তাদের মধ্যে কেউ যদি নির্বাচনকালীন সরকারে থাকতে চান, তা হলে নিতে রাজি আছি। এর আগে আমরা (বিএনপিকে) নিয়েছি। এমনকি ২০১৪ সালেও খালেদা জিয়াকে আমি আহ্বান করেছিলাম; তারা আসেননি। এখন তো তারা পার্লামেন্টে নেই। কাজেই তাদের নিয়ে চিন্তা করারও কিছু নেই। আলোচনা প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, কাদের ডাকব? কীসের জন্য ডাকতে যাব? তাদের দাবিই তো ঠিক নেই।
ঢাকায় কর্মরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে আগামী জাতীয় নির্বাচন। এ ইস্যুতে বেশি সরব যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। আগামী সংসদ নির্বাচন যেন অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক তথা গ্রহণযোগ্য হয়, তা নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে তারা জানাচ্ছেন তাদের দেশের আগ্রহের কথা। তারা আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খোঁজার কথা বলছেন। এর মধ্যেই গত ২৪ মে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে বাংলাদেশের জন্য নতুন একটি ভিসানীতির ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি জে ব্লিঙ্কেন এ সংক্রান্ত ঘোষণা প্রদানকালে বলেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে দুর্বল করার জন্য বা বাধা প্রদানের জন্য দায়ী ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের মার্কিন ভিসা প্রদানে বিধি নিষেধ আরোপ করা হবে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে যারা এগিয়ে নিতে চান, তাদের সমর্থন দিতে নতুন এ নীতির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। নতুন ভিসানীতি তৈরির সঙ্গে যুক্ত মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ভিসানীতি ঘোষণার পর এর ব্যাখ্যায় বলেন, আমরা খুবই গঠনমূলক ও ইতিবাচকভাবে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা বাংলাদেশে সংলাপে ভূমিকা রাখতে চাই। সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে সরকার, বিরোধীদল দল ও নাগরিক সমাজের সবার প্রচেষ্টার সঙ্গী হতে চাই।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি ঘোষণার পরদিনই আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির প্রতিনিধিরা ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ডাকে তার বাসায় বৈঠকে বসেন। এর মূল আলোচ্য বিষয় ছিল- অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করা। ওই বৈঠকেও মার্কিন রাষ্ট্রদূত সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সংলাপের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এ বিষয়ে মার্কিন দূত উপস্থিত তিন দলের প্রতিনিধিদের মনোভাব জানতে চাইলে তারা দলীয় অবস্থান অনুযায়ী তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন। রাষ্ট্রদূতের তরফে জানানো হয়, বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে সরকার, বিরোধী দল ও নাগরিক সমাজের সবার প্রচেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রও অংশীদার হতে চায়। এক্ষেত্রে সংলাপেও ভূমিকা রাখতে চায় দেশটি।
বৈঠক সূত্র জানায়, ন্যূনতম কী পরিস্থিতিতে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিতে পারে-এ প্রসঙ্গে বিএনপির প্রতিনিধিরা জানান, তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলেও নির্বাচনকালীন সরকার অবশ্যই নিরপেক্ষ হতে হবে। তা হলেই বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিরা জানান, সংবিধান অনুযায়ী সরকার ও আওয়ামী লীগ একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়। সেটি শুধু কথার কথা নয়, আমরা করে দেখাব। যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনে বাধা ও সহিংসতা চায় না, আমরাও চাই না। আওয়ামী লীগের তরফে স্পষ্ট করা হয়, সংবিধানের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
অন্যদিকে বাংলাদেশের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ডেলিগেশন প্রধান চালর্স হোয়াইটলি রাজনৈতিক সংকট কাটাতে আলোচনাকেই যে গুরুত্ব দিচ্ছেন, তা স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, আমার বিশ্বাস রাজনৈতিক দলগুলো জানে, নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা। কোন দল অংশ নেবে, তা একান্তই তাদের পছন্দের বিষয়। তবে পরস্পরের প্রতি যদি কোনো অবিশ্বাস থাকে, তবে সংলাপে বসা যেতে পারে। ইইউর ঢাকা প্রধান বলেন, জাতীয় নির্বাচনে সাধারণ মানুষের মতামত প্রতিফলিত হবে বলেই প্রত্যাশা তাদের।
এদিকে আগামী ৮ জুলাই ১৩ দিনের মিশনে ঢাকায় আসছে ইইউর নির্বাচন-পূর্ব পর্যবেক্ষক দল। বাংলাদেশের নির্বাচনী পরিবেশ ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজসহ সশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গেই তারা আলোচনা করবেন, বলছে সূত্র।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসেছিল নির্বাচন কমিশন। সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর লিখিত ও মৌখিক বক্তব্যে ঘুরেফিরে আলোচনায় এসেছে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা কী হবে, তা নিয়ে। প্রসঙ্গক্রমে টানা হয় গত দুটি জাতীয় নির্বাচনের প্রেক্ষাপটও। আওয়ামী লীগসহ ১৪টি রাজনৈতিক দল সরাসরি নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে তাদের অবস্থান জানায়। এর মধ্যে চারটি রাজনৈতিক দল বর্তমান সরকার রেখেই নির্বাচনের পক্ষে মত দেয়। আওয়ামী লীগ ছাড়া বাকি তিনটি দল ওই সরকারকে দৈনন্দিন কাজে সীমাবদ্ধ রাখার প্রস্তাব করে। বাকি ১০টি রাজনৈতিক দল বর্তমান সরকার রেখে নির্বাচন আয়োজনের বিপক্ষে মত দিয়েছে। বিএনপিসহ ৯টি রাজনৈতিক দল সংলাপে অংশ নেয়নি, যাদের বেশিরভাগই নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনরত। এছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠানকালে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করতে ৯টি রাজনৈতিক দল তফশিল ঘোষণার পর সংসদ ভেঙে দেওয়ার দাবি জানায়।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপিকে নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেয় বিএনপি।
কূটনীতিকদের আলোচনার আহ্বানকে কীভাবে দেখেন? এমন প্রশ্নে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, সংলাপের বিষয়ে আমাদের অবস্থান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যেই পরিষ্কার করেছেন। বলেছেন, সংলাপ হবে কার সাথে? কিসের স্বার্থে? তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে কোনো আলোচনা নয়। নির্বাচনে হবে সংবিধান অনুযায়ী। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এ ব্যাপারে বলেন, শেখ হাসিনার অধীনে আমরা কোন নির্বাচনে আমরা যাব না, এটা আমাদের স্পষ্ট ঘোষণা। কারণ শেখ হাসিনার অধীনে গত দুটি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। তার পক্ষে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয় এটা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত। অতএব সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন ইস্যুতে শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করে লাভ হবে না। প্রথমে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, এরপর আলাপ আলোচনা করা যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, অতীতে এ দেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে গণতান্ত্রিক বিশ^ এবার অগ্রিম কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে। আর শেখ হাসিনা যখন থাকবে না, তখন যে কোনো আলোচনার উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাব।
সংকট সমাধানে সংলাপের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের। তিনি বলেন, আমরা মনে করি অবশ্যই সংলাপের প্রয়োজন আছে। এক্ষেত্রে সরকারকেই (ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ) উদ্যোগ নিতে হবে। এবং এ সংলাপে খোলা মন নিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)-এর সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের বক্তব্য দুটো। তা হলো- বিদেশিরা কথায় কথায় নাক গলাচ্ছে। এটা বাংলাদেশের জন্য অনভিপ্রেত এবং অনাকাঙ্খিত। কিন্তু তারা এই সুযোগ পাচ্ছে বর্তমান সরকারের দুর্বলতার কারণে। সরকার নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। তাই নির্বাচনী ব্যবস্থার আমুল সংস্কার করতে হবে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়, তা নিয়ে আলোচনা দরকার। এটা জনগণের দাবি। সুতরাং এ দাবি মেনে নিয়েই সরকার আলোচনা করবে প্রত্যাশা করি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন