সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে (ওয়ান-ইলেভেন) বাংলাদেশের খ্যাতনামা কার্টুনিস্ট খলিলুর রহমান একটি কার্টুন এঁকেছিলেন যা ব্যাপক আলোচিত হয়। খলিলের আঁকা সেই কার্টুনে দেখা যায়, একটি গাড়ির চালকের আসনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদ। পেছনে অন্য একজন গাড়ির স্টিয়ারিং ঘোরাচ্ছেন। যা দিয়ে বোঝানো হয়েছিল দৃশ্যত ফখরুদ্দীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হলেও তাকে পেছন থেকে অন্য কেউ পরিচালনা করছেন। এভাবে বিভিন্ন সরকারের সময়ে কার্টুন হাজার শব্দের চেয়ে বেশি শক্তিশালী বক্তব্য নিয়ে হাজির হতো।
এর বাইরেও স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কার্টুনের বহুল ব্যবহার দেখা যেত। এর ধারাবাহিকতায় দেখা গেছে কার্টুনিস্টরা দেশের বড় বড় রাজনীতিবিদদের ব্যঙ্গ করে কার্টুন আঁকতেন। দেশের প্রধান প্রধান গণমাধ্যমে খবরের পাশে জায়গা করে নিত রাজনৈতিক কার্টুন।
সোমবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে ‘ইআরকি’র ‘রাজনৈতিক কার্টুন প্রদর্শনী’তে এসব আলোচনায় হয় দর্শক ও আয়োজকদের সঙ্গে। রাজধানীর ধানমন্ডির ইএমকে সেন্টারে এ প্রদর্শনী চলবে বুধবার (২৯ মার্চ) পর্যন্ত।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ কার্টুনিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ ও ইআরকি আয়োজিত রাজনৈতিক কার্টুন প্রদর্শনীর অন্যতম আয়োজক মেহেদী হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক কার্টুনের ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। ইতিহাসের নানা বাঁকে রাজনৈতিক কার্টুন হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের ভাষা। মুক্তিযুদ্ধের সময় এমনকি স্বৈরশাসনের সময় থেকে শুরু করে যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে কার্টুন যোগ করেছিল নতুন মাত্রা।
মেহেদী হক জানান, প্রদর্শনীর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশে রাজনৈতিক কার্টুনের ঐতিহ্য তুলে ধরা। ব্রিটিশ শাসন কিংবা পাকিস্তান আমলেও এর প্রচলন ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে এ কার্টুন কমে যাচ্ছে। আবার তরুণরাও কিছুটা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। রাজনৈতিক কার্টুনের ক্ষেত্রে সরকারে চাপের কথা মাথায় রেখে আমরা স্যাটায়ার করি আবার কিছুটা সেলফ সেন্সর করি। আমাদের আয়োজনে তরুণরা কেন আঁকতে চান না, সেটা নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা এবং দিকনির্দেশনা দেবেন দেশ সেরা কার্টুনিস্ট রফিকুন নবী, শিশির ভট্টাচার্য, আহসান হাবীবসহ কার্টুনিস্টরা।
এখন রাজনীতিতে কার্টুনের ব্যবহার কমে গেছে কি না জানতে চাইলে অগ্রগণ্য শিল্পী ও কার্টুনিস্ট রফিকুন নবী (রনবী) দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশে রাজনৈতিক সহনশীলতা চূড়ান্তভাবে কমে গেছে। তারা কার্টুনের মহাত্মা বুঝতে পারেন না। ফলে সহজ বিষয়কে জটিল করে একটা বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন। একজন কার্টুনিস্টের জন্য স্বাভাবিক যে পরিবেশ তা কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতায় পুরোপুরি নেই।
তিনি জানান, কার্টুনিস্টদের একদিকে আর্থিক সহযোগিতা করা হচ্ছে না, অন্যদিকে তাদের মনোবল চাঙা বা সাহস জোগানোর জন্য পাশে দাঁড়ানোর মতো সংগঠন বা মানুষের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে মিডিয়ারও বড় একটা দায় রয়েছে।
বিখ্যাত এই কার্টুনিস্ট বলেন, কার্টুনের একটা অন্য মজা আছে। আমি আশাবাদী একটা সময় সবাই এ মজাটা বুঝতে পারবে। আপনি এক হাজার শব্দ দিয়ে যেটা বোঝাতে পারবেন না, হয়তো বা খুব ছোট একটা কার্টুন দিয়ে সেটা বোঝাতে পারবেন। বর্তমানে কার্টুন হয়তো আগের মত প্রকাশ হয় না তবে এর চর্চা কিন্তু থেমে নেই।
প্রদর্শনীতে অংশ নেয়া কার্টুনিস্ট আহসানুল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থী অভ্র দীপ বলেন, অনেক কিছু আছে যেটা আমরা সরাসরি প্রকাশ করতে পারি না। কিন্তু ইঙ্গিতের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিতে পারি। এ ক্ষেত্রে কার্টুন একটা বড় হাতিয়ার।
তরুণ এ কার্টুনিস্ট জানান, নবীনদের জন্য নিজের সৃজনশীল ভাবনা ধরে রাখা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি ডিজিটাল সিকিউরিটি একটা একটা বড় প্রতিবন্ধক।
এতে অংশ নেওয়া স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ও কার্টুনিস্ট উদয় মেহেদী জানান, আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এখন কথা বলার সুযোগ অনেক কমে গেছে। এ বোধ আসার পর থেকে কার্টুন আঁকার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বলার জায়গাটা নেই। কিন্তু কার্টুনিস্টরা মুখে কিছু না বলে কেবল কার্টুন দিয়ে অনেক কিছু বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন