অর্থনৈতিক সংকট ও বিরোধী দল বিএনপির রাজপথে জোরালো উপস্থিতি—ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের জন্য এ দুটি বিষয় বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে এসেছে। দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে সরকার পরিচালনায় এমন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েনি আওয়ামী লীগ।
এই পরিস্থিতিতে দুটি বিষয়ে জোর দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা—প্রথমত, জনগণকে পাশে পেতে তাদের মন জয়ের চেষ্টা করছেন, আবার ক্ষমতায় আসতে ভোটের জন্য আকুতি জানাচ্ছেন। প্রয়োজনে জনগণের কাছে ভুলত্রুটির জন্য ক্ষমা চাইতেও দ্বিধা করছেন না। বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই মোকাবিলা করতে পারবেন, সেই বার্তাও দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের বিশ্বাস, বিরোধীদের কাছ থেকে যে চ্যালেঞ্জ আসছে, তা মোকাবিলা করার জন্য দলের ঐক্য জরুরি। আর ভোট পেতে হলে সরকারের উন্নয়নকাজের প্রচারের পাশাপাশি মানুষের প্রতি নমনীয়তা দেখানো দরকার।
দ্বিতীয়ত, দলের বিভেদ মিটিয়ে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা আছে আওয়ামী লীগে। দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা দলটিতে নেতা–কর্মীদের মধ্যে পাওয়া না–পাওয়ার অসন্তোষ আছে, যা দলে বিভেদ তৈরি করেছে। দলীয় কর্মকাণ্ডেও ছিল শৈথিল্য। এবার দলের জেলা ও উপজেলা সম্মেলনের মাধ্যমে এই বিরোধ মেটানোর দিকে নজর দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। এমনকি নিজেরা ঐক্যবদ্ধ না হলে বিরোধীদের কাছ থেকে যে বড় চ্যালেঞ্জ আসতে পারে, সেই বার্তাও দিচ্ছেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে করতে হবে, বিরোধীরা এই দাবিতে ইতিমধ্যে মাঠ গরম করার চেষ্টা করছে। দাবিটি আগামী দিনগুলোতে আরও জোর পাবে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। তাঁদের ধারণা, যদি বর্তমান সরকারের অধীনেও নির্বাচন হয়, তাহলেও আগের মতো সহজে জয় পাওয়া যাবে না।
দয়া করে অহংকার করবেন না। এখন থেকে জনগণের দুয়ারে যান। মানুষের মন জয় করুন।
আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, আওয়ামী লীগ
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা দলের বৈঠকগুলোতে প্রায়ই বলছেন, আসন্ন নির্বাচন কঠিন হবে। তিনি কাউকে জয়ী করার দায়িত্ব নেবেন না। শীর্ষ ও মধ্যম সারির নেতারা ইতিমধ্যে এই বার্তা পেয়েছেন। এখন তা আওয়ামী লীগের নেতারা তৃণমূলেও ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন বলে দেখা যাচ্ছে। এ জন্য আওয়ামী লীগের তৃণমূলের সম্মেলনগুলোতে কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্যে জনগণের প্রতি আকুতি এবং দলের নেতাদের প্রতি ঐক্যের ডাক থাকছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের বিশ্বাস, বিরোধীদের কাছ থেকে যে চ্যালেঞ্জ আসছে, তা মোকাবিলা করার জন্য দলের ঐক্য জরুরি। আর ভোট পেতে হলে সরকারের উন্নয়নকাজের প্রচারের পাশাপাশি মানুষের প্রতি নমনীয়তা দেখানো দরকার।
নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে অংশ নিয়ে গত বৃহস্পতিবার দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে এর ইঙ্গিত মেলে।
জনতার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ।
জনতার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ।ফাইল ছবি
তিনি সরকার, আওয়ামী লীগ মনোনীত সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, মেয়র, ইউপি চেয়ারম্যান বা নেতা-কর্মীদের আচরণগত কারণে কেউ কোনো কষ্ট পেয়ে থাকলে তাদের পক্ষ থেকে জনগণের কাছে নিঃশর্তভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগে কিছু মন্দ মানুষ আছে। তাদের কারণে আমাদের শাস্তি দেবেন না। আমাদের ওপর অভিমান করলে দেশের প্রতি শাস্তি প্রদান করা হবে।’ তিনি দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘দয়া করে অহংকার করবেন না। এখন থেকে জনগণের দুয়ারে যান। মানুষের মন জয় করুন। তাঁদের বোঝান, তাঁদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে নৌকার পক্ষে ভোট চান।’
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
আবু সাঈদ আল মাহমুদের এই বক্তব্য এখন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৌশল বলে জানিয়েছেন দলের নেতারা। তাঁরা বলছেন, নিত্যপণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় চাপে থাকা মানুষ বিরোধীদের প্রতি সমর্থন দিতে পারে, এই শঙ্কা আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আছে। এ ছাড়া দলের জনপ্রতিনিধি ও নেতাদের কাছ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষও বিপদের সময় বিপক্ষে অবস্থান নিতে পারে। এ জন্য জনগণকে পাশে চাইছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। এ ক্ষেত্রে দলের নেতা-কর্মীদেরও শোধরানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকের মত, গত দুটি নির্বাচনে যাঁরা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের বড় অংশ দলের কোনো উপকারে আসেননি। বরং তৃণমূলে বিভেদ তৈরি এবং নিজেদের আখের গোছানোর চেষ্টায় ব্যস্ত ছিলেন তাঁরা। এ জন্য দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচনে কাউকে জিতিয়ে আনা হবে না, এমন বার্তা দিয়েছেন।
জনগণের প্রতি আকুতি এবং দলে ঐক্য প্রতিষ্ঠার বার্তা সম্পর্কে শুক্রবার রাতে কথা হয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ দল ও জনগণের শক্তিতে বিশ্বাস করে। এ জন্য দলকে সংগঠিত করা এবং জনগণের কাছে যাচ্ছে। দলের নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা যদি কাউকে কষ্ট দিয়ে থাকেন, তাতে ক্ষমা চাইতে তো কোনো সমস্যা নেই।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আওয়ামী লীগের সভা–সমাবেশে যোগ দিয়ে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দিচ্ছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আওয়ামী লীগের সভা–সমাবেশে যোগ দিয়ে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দিচ্ছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ফাইল ছবি
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলের প্রতিটি জেলা সম্মেলনে সশরীর বা ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তৃতা করছেন। এতে তিনি বিরোধী দল বিএনপির সমালোচনা যেমন করছেন, তেমনি তাঁর কণ্ঠে সাধারণ মানুষের প্রতি আকুতিও থাকছে। গত শনিবার গাইবান্ধা জেলা সম্মেলনে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে আওয়ামী লীগকে বাঁচাতে হবে, মুক্তিযুদ্ধকে বাঁচাতে হলে আওয়ামী লীগকে বাঁচাতে হবে। উন্নয়নের জন্য আরেকবার দরকার, শেখ হাসিনার সরকার।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্রের খবর হচ্ছে, গত দুটি জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করেছে, তাতে দল বা সরকারের বড় কোনো অর্জন হয়নি। এই সুযোগে এমন অনেক নেতা সংসদ সদস্য হয়ে গেছেন, যাঁদের মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। বিদেশের বন্ধুদের কাছ থেকেও নানা সমালোচনা শুনতে হয়েছে।
সম্প্রতি জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেছেন, ‘আমি শুনেছি, (গত নির্বাচনে) পুলিশের কর্মকর্তারা আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছেন। আমি অন্য কোনো দেশে এমন দৃষ্টান্তের কথা শুনিনি।’
বন্ধুপ্রতিম একটি দেশের রাষ্ট্রদূতের কাছ থেকে এমন বক্তব্য বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে আওয়ামী লীগকে। সামনের দিনগুলোতে এ ধরনের বিব্রতকর বক্তব্য কিংবা চাপে ফেলার বার্তা আরও আসতে পারে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। এই পরিস্থিতিতে দলের শক্তি এবং সাধারণ মানুষের সমর্থন দেখাতে পারা আওয়ামী লীগের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকের মত, গত দুটি নির্বাচনে যাঁরা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের বড় অংশ দলের কোনো উপকারে আসেননি। বরং তৃণমূলে বিভেদ তৈরি এবং নিজেদের আখের গোছানোর চেষ্টায় ব্যস্ত ছিলেন তাঁরা। এ জন্য দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচনে কাউকে জিতিয়ে আনা হবে না, এমন বার্তা দিয়েছেন। এই বার্তা থেকে আওয়ামী লীগের নেতাদের বিশ্লেষণ হচ্ছে, আগামী নির্বাচনে হয়তো সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জোর দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। ১৬০ কিংবা এর চেয়ে কিছু বেশি আসন নিয়ে সরকার গঠন করতে পারাকেই লক্ষ্য হিসেবে ঠিক করেছে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব।
আগামী ২৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন। এর আগে সারা দেশে জেলা ও উপজেলা সম্মেলন করা হচ্ছে। গত দুই মাসে অর্ধেকের বেশি জেলা-উপজেলার সম্মেলন হয়েছে।
আওয়ামী লীগের নেতাদের মতে, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে একেকজন নেতাকে তৈরি করতে ১০ থেকে ১৫ বছর লেগে যায়। ফলে হুট করে তাঁদের বাদ দেওয়া হয় না। অসুস্থ কিংবা মারা গেলেই পরিবর্তন আসে।
১২ অক্টোবর থেকে বিএনপি বিভাগীয় গণসমাবেশ শুরু করেছে। এর পর থেকে আওয়ামী লীগ তাদের জেলা সম্মেলনগুলোতেও বিপুল জমায়েতের চেষ্টা করছে।
আওয়ামী লীগের জেলা সম্মেলনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদ ঘোষণা করা হচ্ছে। পরে পূর্ণাঙ্গ কমিটি হবে। অধিকাংশ স্থানেই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আগের কমিটির নেতারাই থেকে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের নেতাদের মতে, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে একেকজন নেতাকে তৈরি করতে ১০ থেকে ১৫ বছর লেগে যায়। ফলে হুট করে তাঁদের বাদ দেওয়া হয় না। অসুস্থ কিংবা মারা গেলেই পরিবর্তন আসে। তবে পরিবর্তন হোক না হোক—একটা জেলা বা উপজেলা সম্মেলন স্থানীয় পর্যায়ে চাঞ্চল্য আনে। এই মুহূর্তে এটাই দরকার আওয়ামী লীগের।
আওয়ামী লীগের দুজন কেন্দ্রীয় নেতা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় এই প্রতিবেদককে বলেন, আওয়ামী লীগের নেতা, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের অধিকাংশেরই এত দিন ধারণা ছিল জনগণের কাছে আর যেতে হবে না। এই ধারণা দলের অনেক ক্ষতি করেছে, যা মেরামতের চেষ্টা চলছে। কতটা পারা যাবে, সেটা সময়ই বলে দেবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন