দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হলো জাতীয় পার্টি (জাপা)। রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা কারণে আলোচিত ও সমালোচিত এই দল। দলের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বেঁচে থাকতেই ছিল নানা আলোচনা-সমালোচনা। বারবার ভাঙনের মুখে পড়লে সেখান থেকে ফিরিয়ে এনেছিলেন তিনি। কিন্তু তার মৃত্যুর পর দলের ভেতর দ্বন্দ্ব এখন প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে এবং দুই মেরুকরণে বিভক্ত হয়েছে। এরশাদের স্ত্রী এবং দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ এবং দলের চেয়ারম্যান ও এরশাদের ছোট ভাই জি এম কাদেরকে ঘিরে দুই গ্রুপের দ্বন্দ্ব এখন অনেকটাই দৃশ্যমান। এর বাইরে এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশাকে ঘিরে দলের ভেতর একটি গ্রুপ সক্রিয়। নানাভাগে বিভক্ত দলের শীর্ষ নেতারাও। তবে সেটা কখনোই স্বীকার করেননি দলটির নেতাকর্মী।
সাম্প্রিতক সময়ে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় বাজেট অধিবেশনে অংশ নিতে থাইল্যান্ড থেকে দেশে আসেন জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। মতবিনিময় সভা করেছেন দলের বিভিন্নস্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে। ওই মতবিনিময় সভায় দলটির ভাঙনের চিত্র আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সভায় রওশন এরশাদ আক্ষেপ করে বলেছেন, পল্লীবন্ধু এরশাদ নেই, তাই আজ জাতীয় পার্টি এলোমেলো হয়ে গেছে। জাতীয় পার্টিতে স্বেচ্ছাচারিতা চলছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। রওশন এরশাদ তার বক্তব্যে ক্ষোভপ্রকাশ করে বলেন, ‘দীর্ঘ ছয়মাস আমি থাইল্যান্ডের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলাম। পার্টির কেউ খোঁজ নেয়নি আমার।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় পার্টির দলের নেতারা এখন যত না দলের জন্য কাজ করছেন, তার চেয়ে বেশি সক্রিয় সরকারের পক্ষে। ফলে সাংগঠনিকভাবে দল এগোচ্ছে না। দলের ভেতর দ্বন্দ্ব দিন দিন প্রকট হচ্ছে। জাপার জ্যেষ্ঠ নেতারাও এব্যাপারে উদ্বেগের কথা বলেছেন। তাদের মতে, জাতীয় পার্টির গুটি কয়েক সিনিয়র নেতা আছেন, যারা তাদের নিজেদের স্বার্থে পার্টিকে আজ এই অবস্থানে এনেছেন। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির যে কয়জন সংসদ সদস্য রয়েছেন, তারাও সরকারের বাইরে যেতে চান না। তারা সংগঠনের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে থাকলেও সরকারি দলের জন্য কাজ করতে সময় ব্যয় করেন বেশি।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও দলের মধ্যে মতভেদ লক্ষ্য করা গেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এককভাবে ৩০০ প্রার্থী দিয়ে অংশগ্রহণের কথা বলে আসছে দলটির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের (জি এম কাদের) এবং মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। জি এম কাদের সম্প্রতি সরকারের সমালোচনা করেও বক্তব্য দিচ্ছেন। সরকারকে কর্তৃত্ববাদী আখ্যা দিয়ে এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি। বলেছেন, দলের কেউ ‘সরকারের দালালি’ করলে পস্তাতে হবে। অন্যদিকে জাতীয় পার্টি সংসদ সদস্যগণ সরকারের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে থাকতে আগ্রহী। তারা বলছেন যে, দল এককভাবে ৩০০ প্রার্থী দিয়ে অংশগ্রহণের কথা বলে আসছে। কিন্তু এককভাবে সব আসনে প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সক্ষমতা দলটির নেই। দলের হেভিওয়েট নেতাদের অবস্থানই নড়বড়ে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক ভবিষ্যত কি সেটা সুনির্দিষ্ট করে বলা মুসকিল। কারণ অতীতে রাজনীতিতে জাপা বেশ নাটকী ভূমিকা রেখেছে। তবে দলটি এখন যে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তাতে দলটির রাজনৈতিক ভবিষ্যত নিয়ে এক ধরনের শঙ্কা রয়েছে। নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে কিছু না বললেও দলটি এখন দুটি মেরুকরণে বিভক্ত। জি এম কাদের রওশন এরশাদের সঙ্গে সমঝোতা করে চললেও বিদিশা এরশাদ জি এম কাদেরের জন্য অস্বস্তিকর হয়েই থাকবে। ফলে জাতীয় পার্টির ভাঙনরোধ সহসাই হচ্ছে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন