নারীদের প্রতি বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিয়ে তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ এখন সমালোচনায়। রবিবার (৫ ডিসেম্বর) রাত থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার সঙ্গে চিত্রনায়ক ইমন ও চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে। ফোনালাপে তিনি মাহিকে উদ্দেশ্য করে ধর্ষণের হুমকি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে তাকে তুলে নিয়ে আসার হুমকি দেন। নারী অধিকার নিয়ে কাজ করেন, যারা তারা বলছেন, সরকারের একটি দায়িত্বশীল পদে থাকা কেউ এ ধরনের হুমকি ও বক্তব্য প্রদানের পরে তার আর পদে থাকার যোগ্য থাকেন না।
ইতোমধ্যে ফোনালাপে থাকা চিত্রনায়ক ইমন স্বীকার করেছেন এই ফোনালাপ তাদেরই। তবে তিনি এও দাবি করেন যে এটি ২০২০ সালের ঘটনা। অধিকারকর্মীরা বলছেন, ঘটনা যখনকারই হোক, ফোনালাপ সত্য হলে সেটি বিবেচনায় নিয়ে পদচ্যুত করার ঘটনা আন্তর্জাতিকভাবে নানা সময়ে দেখা গেছে।
২০১৭ ও ২০১৮ সালে বিভিন্ন দেশে রাজনীতি, ব্যবসা, শিল্প-সংস্কৃতির জগতের বেশ কয়েকজন শীর্ষ ব্যক্তির বিরুদ্ধে যৌন অত্যাচারের অনেকগুলো ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। যার কোনওটিই ওই সময় ঘটেনি। হলিউডের শীর্ষ প্রযোজক হার্ভি ওয়েইনস্টিনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল নীরবতা ভাঙার পালা। ফক্স নিউজের সিইও রজার এলস, সিনেটর আল ফ্রাঙ্কেন, অভিনেতা কেভিন স্পেসি থেকে শুরু করে একই ধরনের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন আমাজন স্টুডিওর প্রধান রয় প্রাইস, বিখ্যাত মার্ক হালপেরিন, চিত্র পরিচালক জেমস টবাক, ন্যাশনাল পাবলিক রেডিওর টম অ্যাশব্রুক ও টিভি হোস্ট চার্লি। অভিযোগ ওঠার পর তাদের কেউ চাকরি খুইয়েছেন, কেউ পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন, কেউবা নাকে খত দিয়ে বলেছেন যে ভুল হয়েছে, আর করবো না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা আখতার বলেন, ‘অডিওটি যদি প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদের হয়ে থাকে তবে একজন প্রতিমন্ত্রীর এমন ভূমিকা এবং তিনি কী চর্চা করছেন দেখে ভীষণ ভয় হয়। তার পদস্থ কেউ যদি এরকম বলতে পারে, তার মানে ধর্ষণ করতে চাওয়ার ব্যাপারটা এতোটাই স্বাভাবিক! তার মতো দায়িত্বশীল পদের কারও কাছ থেকে এ ধরনের বক্তব্য ভীষণ শঙ্কার।’
তিনি আরও বলেন, ‘তার মানে, ধর্ষণ করার সংস্কৃতি, নির্যাতন ও নিপীড়নের যে অবস্থা তা উচ্চপর্যায় থেকে জারি আছে। এটা নাগরিক হিসেবে অনিরাপত্তার বোধ জন্ম দিচ্ছে। সর্বশেষ যে অডিও প্রকাশ হয়েছে—তার আগেও যেসব কথাবার্তা তিনি বলছিলেন—সেটা আমাদের দেখিয়ে দেয় আমরা কীসের মধ্যে আছি। আমাদের কাছে স্পষ্ট হচ্ছে যে—চাইলেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করা যায়। বাহিনী ব্যবহারের কথা যেকোনও পরিস্থিতিতে বলা যায়। প্রতিমন্ত্রী এটা বলতে পারেন মানে, এমনটা ঘটে বা ঘটানো যায় বলে তিনি মনে করেন। তার মানে কি এই যে, রাষ্ট্রযন্ত্র তার নাগরিকের বিরুদ্ধে?’
অবিলম্বে তাকে এই পদ থেকে সরিয়ে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষা করা দরকার উল্লেখ করে সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টি বলেন, ‘আজ তথ্য প্রতিমন্ত্রী যা করেছেন, বলেছেন তা রাষ্ট্রকে অস্তিত্বের সংকটের জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ব্যক্তি মুরাদ যা করেছেন এবং করছেন তা এদেশের চরম পুরুষতান্ত্রিক চরিত্রের নগ্নতম প্রকাশ। এ জন্য তার শাস্তি হওয়া উচিত। আইনে এরকম অপরাধীর শাস্তির বিধান রয়েছে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগের যত বড় ক্ষতি এই লোকটি একা করেছেন তত ক্ষতি আমাদের জানামতে আর কেউ করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ইতোমধ্যেই দল থেকে বিরাট বিরাট বোঝা সরানোর কাজ করছেন। এই লোকটির মতো কাউকে ঝেড়ে ফেললে দলের ক্ষতি বাড়বে না বরং মানুষ দলটির প্রশংসাই করবে।’
তিনি আরও বলেন, “দুঃখজনক হলো, দেশে এমন ‘মুরাদ’ সব দলে, সব পক্ষে আছে। যখন একপক্ষের ‘মুরাদ’ এমন কিছু করে তখন অন্য পক্ষের মুরাদরা আমাদের মতো নারীর নাম নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গালির হাট বসায়। তখন মুরাদ গং এক হয়ে যায়। বিচ্ছিন্ন ঘটনার পর প্রতিবাদ নয়; সামাজিক, রাষ্ট্রীয়— সর্বোতভাবে নারী অবমাননা বন্ধ করতে হবে এবং সে জন্যই মুরাদদের মতো লোকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই যে বারবার তিনি ধর্ষকামী জায়গা থেকে বলেই যাচ্ছেন, এরপর তিনি প্রজাতন্ত্রের যে জায়গায় আছেন সেখানে থাকতে পারেন না। স্পষ্টতই তিনি পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘এর আগে আমরা বিএনপির আমলে মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে দেখেছিলাম বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কুৎসিত মন্তব্য করতে। কাজেই, যারা যখন ক্ষমতায় আসছে তারা মনে করছে এসব করে পার পাবে। নারী প্রশ্নে দলের অবস্থান কী তা এসব দেখে বোঝা যায়। আপাতত আমি পর্যবেক্ষণে রইলাম—দলগতভাবে এটা নিয়ে আওয়ামী লীগ কী অবস্থান নেয় দেখা যাক।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন