তৃতীয় দফায় অনুষ্ঠিত হওয়া ফরিদপুরের ভাঙ্গা ও চরভদ্রাসন উপজেলার ১৫ ইউপি নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের ভরাডুবি হয়েছে। এতে ১৪টিতে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর পরাজয় হয়েছে। নয়টিতে বর্তমান এমপির সমর্থিত, চারটিতে বিএনপির সমর্থিত এবং একটি নৌকা ও এক স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন।
আওয়ামী লীগের এলাকা হিসাবে পরিচিত ফরিদপুর-৪ আসনে নৌকা প্রতীকের এমন পরাজয়ে বিষয়ে দলটির তৃণমূল থেকে শুরু করে জেলা পর্যায়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে।
তবে এমন পরাজয়ের বিষয়ে স্থানীয় (বর্তমান এমপি) মুজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন) দাবি করেন, সঠিক ও যোগ্য ব্যক্তিদের মনোনয়ন না দেওয়ায় পরাজয়।
অন্যদিকে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মাসুদ হোসেন দাবি করেছেন, স্থানীয় নির্বাচনে দলের পরিচয়ের চেয়ে প্রার্থীর ভূমিকা বেশি থাকে।
রবিবার (২৮ নভেম্বর) সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ভোট শেষে গণনার পর ভাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজিমউদ্দিন খান জানান, এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ রাজনৈতিক দল তাদের দলীয় প্রার্থী দিয়ে ছিল। এ ছাড়া অন্যরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন।
ফরিদপুর জেলার সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা মো. হাবিবুর রহমান বলেন, যে কোনো সময়ের চেয়ে এ নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি ছিলো চোখে পড়ার মতো।
তিনি বলেন, দুই উপজেলায় গড় ৭৪ শতাংশ ভোটার তাদের ভোট প্রয়োগ করেছে। কোথাও কোনো সমস্যা হয়নি। নির্বাচন কর্মকতা থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নিরলস চেষ্টায় শান্তিপূর্ণ ভোটগ্রহণ করতে পেরেছি।
ভাঙ্গা উপজেলার ১২ ইউপিতে যারা নির্বাচিত হয়েছেন তারা হলেন, কাউলিবেড়া ইউনিয়নে রেজাউল হাসনাত দুদু ,আলগী ইউনিয়নে ম.ম. ছিদ্দিক মিয়া, তুজারপুর ইউনিয়নে ওলিউর রহমান, কালামৃধা ইউনিয়নে রেজাউল মাতুব্বর, আজিমনগর ইউনিয়নে শাহজাহান হাওলাদার, মানিকদাহ ইউনিয়নে সহিদুল ইসলাম বাচ্চু, হামিদনগর ইউনিয়নে খোকন মিয়া, ঘারুয়া ইউনিয়নে মনসুর আহম্মেদ মুন্সি, চুমুরদী ইউনিয়নে রফিকুল ইসলাম সোহাগ, নাসিরাবাদ ইউনিয়নে আলমগীর হোসেন, নুরুল্লাগঞ্জ ইউনিয়নে শাহবুর রহমান ও চান্দ্রা ইউনিয়নে খালেক মোল্লা।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ভাঙ্গার ১২টি ইউনিয়নের একটি নৌকা প্রতীক, আটটিতে বর্তমান এমপি মুজিবুর রহমান নিক্সন চৌধুরীর সমর্থিত প্রার্থী এবং দুটিতে বিএনপি সমর্থিক প্রার্থী ও একটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছে।
এ ছাড়া চরভদ্রাসনে উপজেলার তিনটি ইউপিতে যারা জয়ী হয়েছেন তারা হলেন, গাজীরটেকে ইয়াকুব আলী, সদর ইউপিতে আজাদ খান এবং চরহরিরামপুরে জাহাঙ্গীর কবির ।
স্থানীয় সূত্র জানা গেছে, এ উপজেলায় দুটিতে বিএনপি সমর্থিত এবং একটিতে বর্তমান এমপি মুজিবুর রহমান নিক্সন চৌধুরীর সমর্থিত প্রার্থী জয়ী হয়েছেন।
‘নৌকার ঘাঁটিতে’ ভরাডুবির কারণ নিয়ে নেতাকর্মী থেকে শুরু করে স্থানীয়দের মধ্যে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
তাদের আলোচনায় উঠে এসেছে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য প্রার্থী না দেওয়া, স্থানীয় এমপির বিদ্রোহীদের সমর্থন দেওয়া, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, স্থানীয় নেতাকর্মীদের নিষ্ক্রিয়তা ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর (বিদ্রোহী ও বিএনপি) পক্ষে কোনো কোনো নেতার গোপন আঁতাতের বিষয়টিও।
এ ছাড়া বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র (বিএনপি) প্রার্থীদের নৌকাবিরোধী প্রচারও ভরাডুবির কারণ হিসেবে দেখছেন দলটির একাধিক নেতা।
এ বিষয়ে ভাঙ্গা উপজেলার কালামৃধা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন ইস্কান্দার আলী খলিফা। তিনি দলের বিদ্রোহী প্রার্থী (এমপি সমর্থিত) রেজাউল মাতুব্বরের কাছে পরাজিত হয়েছেন। নৌকা প্রতীকের এই পরাজিত প্রার্থী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ তো আর আওয়ামী লীগ রইছে না। বর্তমান এমপি সাহেবের লোকজনই অত্যন্ত সুকৌশলে ডুবাইছে।’
একই উপজেলার আজিমনগর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন আবুল কালাম আজাদ। এই ইউনিয়নে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী (এমপি সমর্থিত) মো. শাহজাহান হাওলাদার জয়ী হয়েছেন। পরাজয়ের কারণ হিসেবে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী বলেন, ‘ভোটে নৌকা জয়ী হোক তা ‘বড় জনপ্রতিনিধি’ চান না। প্রচুর টাকার ছড়াছড়ি হয়েছে, প্রার্থী হিসেবে হয়তো আমাদেরও কিছু দূর্বলতা ছিলো তাই বলে নৌকা এমন পরাজয়।’
এদিকে চরভদ্রাসন উপজেলার সদর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন খোকন মোল্লা। তিনি নৌকা প্রতীক পেয়ে ভোটে এখানে তৃতীয় হয়েছেন। এখানে জয় পেয়েছেন (এমপি সমর্থিত) আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী আজাদ খান। দ্বিতীয় হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মাহফুজুর রহমান। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী খোকন মোল্লা বলেন, ‘আমি এই বিষয়ে এখন মুখ খুলতে চাচ্ছি না। বিচার চাইব আল্লাহর কাছে। তবে নৌকাকে হারানো জন্য বিএনপি-জামায়াতসহ আওয়ামী লীগ বিরোধীরা এক হয়ে কাজ করেছে।’
নৌকা মার্কার প্রার্থীদের এমন ভরাডুবির বিষয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত ভাঙ্গা উপজেলার নাম সর্বজন স্বীকৃত। এরপরও ২০১৪ সালের পর থেকে ভাঙ্গায় জাতীয় নির্বাচন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের একের পর এক ভরাডুবি হচ্ছে।
ফরিদপুর-৪ আসনের এমপি মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন ২০১৪ সালে প্রথম নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই এ অঞ্চলে আওয়ামী রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত হয় বলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও এলাকাবাসী মনে করেন।
তারা বলছেন, বর্তমান এমপি সাহেবের সঙ্গে আওয়ামী লীগের একটি অংশ এবং আওয়ামী লীগের বিরোধীরাও যুক্ত তার সঙ্গে।
এ বিষয়ে ফরিদপুর-৪ আসনের এমপি ও যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মুজিবুর রহমান নিক্সন চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগের এই সময়ে যে উন্নয়ন হয়েছে তা অতীতে কখনো হয়নি, তবে কেনো নৌকার পরাজয় হবে?
তিনি অভিযোগ করে বলেন, অযোগ্য ব্যক্তিদের দলীয় মনোনয়ন দেওয়ায় হয়তো এমন রেজাল্ট হয়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এলাকার গ্রহণযোগ্য এবং মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিকে বেছে নিতে না পারায় এমন ফল।
দলের প্রার্থীদের ভোটে এমন ভরাডুবির বিষয়ে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মাসুদ হোসেন বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলের প্রভাবের চেয়ে প্রার্থীর স্থানীয় প্রভাবটাই গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি স্বীকার করে বলেন, হয়তো আমাদের দূর্বলতা ছিল, বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারিনি। বিদ্রোহীদের পেছনে পাওয়ারফুল লোক থাকায় আমাদের প্রার্থীদের রেজাল্ট এমন হয়েছে।
স্থানীয়রা বলছেন, এ দুটি উপজেলাই ফরিদপুর- ৪ আসনের অন্তর্গত। এই আসনের বর্তমান এমপি যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন। অপরদিকে এ আসনের সাবেক এমপি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্ল্যাহর বাড়ি। ২০১৪ সাল থেকেই এই আসনে আওয়ামী লীগ দুই ধারায় বিভক্ত। একটি নিক্সন গ্রুপ অপরটি কাজী জাফরউল্ল্যাহ গ্রুপ। এবারের ইউনিয়ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্ল্যাহর অনুসারিরা। অপরদিকে এমপি নিক্সন গ্রুপের নেতাকর্মীরা সবাই স্বতন্ত্র নির্বাচন করেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন