যে বছর যুবদল নেতা পারভেজ হোসেনকে গুম করা হয়, তখন তার একমাত্র মেয়ের বয়স ছিল দেড় বছর। কী এমন আর বুঝত শিশুটি! সন্তানকে পরম মমতায় বড় করছিলেন পারভেজ। কিন্তু হঠাৎ এক ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল পুরো পরিবার। প্রহসনের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেভাগে রাজধানী থেকে ছেঁকেছেঁকে বিএনপির জনপ্রিয় তরুণ নেতাদের গুম করা শুরু হলো। আর সেই সময়ই নিখোঁজ হন পারভেজ হোসেন।
যুবদলের সেই নেতার ছোট্ট মেয়েটির বয়স এখন ৯ বছর। যখন বুঝতে শিখল, তখন শুনল বাবা বিদেশে থাকেন। কিন্তু, সময় গড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সব জেনেছে পারভেজ হোসেনের মেয়ে আদিবা ইসলাম হৃদি (৯)।
২০১৩ সালের ২রা ডিসেম্বর রাজধানী থেকে গুম করা হয় পারভেজ হোসেনকে। এর একমাস পর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি প্রহসনের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
পারভেজ গুম হওয়ার পর পেরিয়ে গেছে ৮ বছর। তার দেড় মাসের মেয়েটিও বড় হয়েছে। এখন স্থানীয় একটি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। মার সাথে ইস্কুলে যায়।
এখনও বাবার অপেক্ষায় থাকে শিশুটি।
দেড় বছর বয়সে বাবাকে সবশেষ দেখেছিল। কিইবা মনে আছে তার!
তবু আবছা স্মৃতিহাতড়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে শিশুটি। বলল, 'বাবা আমাকে অনেক আদর করত’।
এতটুকুই মনে আছে হৃদির।
অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে হৃদি বলল, 'আমার এখনও ইচ্ছা হয় বাবার সাথে স্কুলে যাব। বাবা আইসক্রিম কিনে দেবে। বাবার সাথে ঘুমাতে ইচ্ছা করে।'
হৃদি বলল,'বাবা যেখানে আছে ভাল থাকুক। জানিনা আমার বাবা এই করোনার ভেতর কোথায় আছে, কেমন আছে। সবসময় নামাজ পড়ে বাবার জন্য দুআ করি। বাবা যেন ফিরে আসে। আমাকে স্কুলে নিয়ে যায়।'
হৃদির পাশেই বসেছিলেন তার মা ফারজানা। মেয়ের অঝোর কান্নার সময় তিনিও নীরবে চোখ মুছছিলেন।
কেমন চলছে তাদের জীবন এখন? প্রশ্ন করতেই চোখ মুছলেন পারভেজ হোসেনের স্ত্রী। বললেন, 'আমাদেরকে যেখানে রেখে গেছেন তিনি, জীবনটা সেখানেই থমকে আছে। আমি আশায় আছি যে পারভেজ ফিরে আসবে। আমাদের সুখতো আর নেই। বাচ্চা নিয়ে অনেক কষ্টে আছি।'
তিনি বলেন, হৃদি যখন বড় হতে লাগল তখন তাকে বলতাম যে তার বাবা বিদেশে থাকেন। এখন হৃদি সব বুঝে। কিন্তু, আমি জানিনা সে কতটুকু বুঝে'।
ফারজানা যখন এসব বলছিলেন তখন পাশে বসে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে হৃদি।
গুম হওয়া যুবদল নেতা পারভেজ হোসেনের স্ত্রী বলেন, 'আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীই আমার স্বামীকে গুম করেছে। অথচ গুম করার পর উল্টা স্থানীয় পুলিশ শুরুর দিকে আমাদের পরিবারকে অনেক হয়রানি করতো। কয়দিন পরপর আসতো বাসায়। পারভেজের খোঁজ নিতো। এমন ভাব করতো যে পারভেজ যেন ইচ্ছা করেই লুকিয়ে আছে।'
তিনি বলেন, স্বামীর খোঁজে র্যাব, পুলিশ, ডিবি সব জায়গায় গিয়েছিলাম। কিন্তু কেউই স্বীকার করেনি।
'আমার স্বামী কোনো অন্যায় করতো তাহলে তার বিচার করতে পারতো। এভাবে পরিবার থেকে আলাদা করার অধিকার তো কারো নাই,' বলেন ফারজানা।
তিনি বলেন, 'আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন যে এলাকায় সবার কাছে খুব জনপ্রিয় ছিলেন পারভেজ। নিয়মিত নামাজ পড়তেন। কোনো মামলা ছিলো নাতা রবিরুদ্ধে। রাজনীতি করাই কি তার অন্যায়।'
'পারভেজ এমন কী করেছে তা আমাদের জানা নেই। এখন একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আমাদের আর কেউ নেই," অঝোরে কেঁদে উঠেন ফারজানা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন