শেখ হাসিনার খুন-গুমের 'রাজনীতি':
সাহসী ও জ্ঞানী প্রতিবাদকারীদের সমীপে
--শেখ হাসান।
এক।
দজ্জাল! ইয়াজুজ-মাজুজ!
মুসলমানরা যাকে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে, "কোন মানুষ তার সাথে পারে নাই, পারবে না।" সেই বিশ্বাসটাকেই পুঁজি করে ১২০১ সালে চেঙ্গিস খান 'দজ্জাল' সেজে যখন বিশ্বের প্রতাপশালী মুসলমানদের উপর আক্রমণ করেছিল, তখন শক্তিমান মুসলমানেরা কোন রকম প্রতিরোধ না করে পলায়নপর হয়েছিল। বলতে গেলে তাই প্রায় বিনা বাধায় মধ্য এশিয়া থেকে তুরস্ক পর্যন্ত প্রতিটি মুসলিম দেশকেই পদাবণত করেছিল মঙ্গোলিয়া থেকে আসা চেঙ্গিস খান। সে এবং তার নাতি হালাকু খান মিলে সেই অঞ্চলকে শাসন করেছে প্রায় শত বছর, অপ্রতিরোধ্যভাবে। বাংলাদেশে যেমন করছে হাসিনা, গত প্রায় তের বছর ধরে। সেই সময় পরিস্থিতি এমন হয়ে পড়েছিল যে, চেঙ্গিস বা হালাকু আসছে, এমন খবর প্রচারিত হলেই পার্শ্ববর্তী দেশ বা নগর থেকে মুসলিম যোদ্ধারা পালিয়ে যেত। আর নির্বিঘ্নে, বিনা বাধায় সেই দেশ বা নগর দখল করে নির্বিচারে তথায় থেকে যাওয়া নারী ও শিশুদের শিরশ্ছেদ করে সেই খন্ডিত মাথা দিয়ে রাস্তার মোড়ে মোড়ে পিরামিড তৈরি করে তাদের নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করত চেঙ্গিস-হালাকু। আর তাই চেঙ্গিস-হালাকুদের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা, চোখ তুলে তাকাতেও সাহস করতো না। এমনি ভাবেই চলছে প্রায় ৭০ বছর।
কিশোর পেরিয়ে সবে যুবাতে পরিণত হয়েছে ওসমান। পড়ালেখা করে স্থানীয় এক মক্তবে। ওসমানের মধ্যে বিশেষ কিছু গুণ ও বৈশিষ্ট্যাবলী পর্যবেক্ষণ করে তার ওস্তাদ একদিন ফিসফিস করে তাকে বলেছিল, "ওসমান! ও'রা (হালাকুরা) দজ্জাল নয়! তোমাদের মতই মানুষ। ঘুরে দাঁড়াও। দেখবে ও'রা পালিয়ে গেছে।" মনোযোগ দিয়ে ওস্তাদের কথা শুনে ওসমান, কিন্তু কোনো মন্তব্য করে না। এভাবেই চলে যায় বেশ কিছুদিন। টগবগে যুবক ওসমান অতিগোপনে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয় অপরাপর তারই কিছু সহযোগীদের নিয়ে। এরপর ওসমানের নেতৃত্বে কমবেশি ৩০জন মুসলিম যুবক একদিন অতর্কিত আক্রমণ করে বসে ৩০০জনের হালাকু বাহিনীর উপর। ছত্রছান হয়ে পলায়ন করে তারা। এতে ভ্রম কাটে মুসলমানদের। তারা নিশ্চিত হয়, প্রতিপক্ষরা তাদের মতই মানুষ! ইয়াজুজ-মাজুজ, দজ্জাল, অশরীরী ইত্যাদি এগুলো কিছুই নয়।
এর পরের ইতিহাস-- ওসমানের নেতৃত্বে মুসলমানদের ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস। ওসমানী খেলাফতের অধীনে পৃথিবীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নিয়ে গঠিত অটোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ইতিহাস। যা ১২৯৯ সালে শুরু হয়ে প্রায় ছয় শত বছর একাধারে শাসন করার পর তার পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯২১ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। তা-ও সম্ভব হয়েছিল মুসলিম নামধারী কতিপয় মুনাফিক শাসক ও সেনাপতিদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণেই। সে আর এক ইতিহাস।
সেই সকল শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিবর্গের কাছে, যাঁরা এই ফ্যাসিস্ট, ভন্ড ও অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে হলেও বাক ও লেখনীর মাধ্যমে কিছুটা প্রতিবাদ করার চেষ্টা করছেন, তাঁদের প্রতি আগাম ক্ষমা চেয়ে এতবড় পটভূমি উল্লেখ করার কারণ হিসেবে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলতে চাচ্ছি এই যে, খুব ব্যতিক্রম বাদে অধিকাংশ লেখনীর মধ্যেই এই মাফিয়া সরকারের অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিরোধের তেমন কোনো উপায় বাতলে না দিয়ে শুধুমাত্র সেই সকল রোমহর্ষক কাহিনীর এমন বর্ণনা দেয়া হচ্ছে, যাতে করে সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যাচ্ছে যে, "এই হাসিনা সরকার অপ্রতিরোধ্য! সুতরাং নীরবে তার সকল অন্যায়-অত্যাচার মেনে নেয়াই নিরাপদ। অন্যথায় জীবনহানিসহ যেকোন অপূরণীয় ক্ষতির শিকার তারা হতে পারেন। আর এমন হলে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসার মত কোন ব্যক্তি বা সংগঠন এদেশে নেই।"
বাস্তব চিত্র কিন্তু কোনক্রমেই এমন অপ্রতিরোধ্য নয়! বরং হাসিনা সরকারের অবস্থা একেবারেই কচু পাতার পানির মতোই টলটলায়মান। শুধুমাত্র অদক্ষ, দুর্নীতিপরায়ন ও নীতিহীন বিরোধী নেতৃত্বই তার টিকে থাকার একমাত্র কারণ। আর কিছুই নয়। তাই এখন আমাদের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে একজন 'ওস্তাদ'-এর। যিনি ওসমানদের যথাযথ উৎসাহ ও উপদেশ দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করবেন। কেননা অভিজ্ঞতা বলে, আমাদের দেশে এমন ওসমানদের সংখ্যা ইতিমধ্যেই হাজার এমনকি লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। এখন শুধু সুসংগঠিত হয়ে পাল্টা আঘাত হানার প্রস্তুতি নেওয়া মাত্র!
আমি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে নিজেও চেষ্টা করব। পাশাপাশি অন্যান্য জ্ঞানী ও সচেতন ব্যক্তিবর্গের প্রতি সবিনয় অনুরোধ জানাব, তাঁরাও যেন সমস্যা বর্ণনার সাথে সাথে তার সম্ভাব্য প্রতিকার-প্রতিরোধের উপায় বাতলে দেন।
দেখলাম 'আমার দেশ.ইউকে' হাসিনা সরকারের খুন-গুম নিয়ে বর্ণনামূলক সিরিজ প্রকাশ করছে। এগুলো জেনে শুধু আতঙ্কিত না হয়ে এর প্রেক্ষিতে আইনানুগ কি কি প্রতিকার-প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া যায় সেই বিষয়েই আমার এই সিরিজ লেখনীর অবতারণা। (চলবে)।
দুই।
প্রতিটি খুন-গুম ঘটনার বিষয়ভিত্তিক করণীয় সম্পর্কে বর্ণনার পূর্বে খুবই কমন তিনটি বিষয় আলোচনা করে নেয়া যাক--
ক# প্রথমত: অপরাধ এবং অপরাধী বলতে কি বুঝায়?
দেশের প্রচলিত আইনে যে কু-কর্মটি করলে আদালত শাস্তি প্রদান করে, সেই কর্মটিকেই অপরাধ বলে।
কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হল এই যে, সেই কর্মটি যে ব্যক্তি ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে সম্পন্ন করে, শুধুমাত্র সেই কিন্তু অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হয় না। তার সাথে সাথে সেই কর্ম সম্পাদন করতে নৈপথ্য থেকে যারা সহায়তা দেয় তারা, এবং এই অপরাধ কর্মটি প্রতিরোধ ও প্রতিকার করার রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব যাদের উপর অর্পিত তাঁরা যদি অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে অথবা উদাসীন হয়ে সেই প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা হতে বিরত থাকে, তাহলে তারাও অপরাধী হিসেবে আইনের চোখে গণ্য হয়। অর্থাৎ আইনের দৃষ্টিতে তারাই অপরাধী--
(১) ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে যারা অপরাধটি সম্পন্ন করে।
(২) নৈপথ্যে থেকে যারা প্ররোচনা বা সহায়তা দেয়।
(৩) প্রতিরোধ ও প্রতিকারের দায়িত্ব পালন হতে যারা বিরত থাকে।
খ# দ্বিতীয়তঃ কোন অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পরবর্তী কত দিনের মধ্যে অভিযোগ বা বিচার সম্পন্ন করতে হয়, নতুবা তা তামাদি হয়ে যায়?
ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ বা বিচারের জন্য কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। দিন-মাস-বছর এমনকি যুগ পেরিয়ে গেলেও অভিযোগ দায়ের বা বিচার অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে কোনো আইনি বাধা নেই। শুধুমাত্র সেই ক্ষেত্রে অভিযোগকারীকে বিলম্বে অভিযোগ দায়েরের গ্রহণযোগ্য কারণ বর্ণনা করতে হয়। সাথে দিতে হয় প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য-প্রমাণ। যা মৌখিক সাক্ষ্য বা ডকুমেন্টেড সাক্ষ্য, উভয়ই আইনে গ্রহণযোগ্য। তবে ডকুমেন্টেড সাক্ষ্য, পত্রিকা প্রকাশিত কাটিং, ভিডিও ফুটেজ ইত্যাদি থাকলে তা অধিকতর গ্রহণযোগ্য হয়।
গ# তৃতীয়তঃ আদালতে অপরাধ প্রমাণের জন্য কতটি এবং কি ধরনের সাক্ষ্য প্রয়োজন হয়?
গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্য যদি একটি বা একজন হয় এবং অভিযোগকারী যদি যৌক্তিকভাবে আদালতকে এই মর্মে সন্তুষ্ট করতে পারেন যে, পরিস্থিতি পরিবেশ বিবেচনায় একটি বা একজনের অধিক সাক্ষ্য আদালতে উপস্থাপনের কোনো সুযোগ বা সামর্থ্য তার নেই। আর পারিপার্শ্বিক অবস্থাদি সার্বিক বিবেচনায় বিজ্ঞ আদালত যদি অভিযোগকারীর সেই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হন, তাহলে সেইরূপ একটি বা একজনের সত্য সাক্ষ্যের ভিত্তিতেই বিজ্ঞ আদালত অপরাধীকে সাজা দিতে পারেন।
উল্লেখ্য, অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, সত্য ঘটনা সত্য সাক্ষ্য দিয়ে প্রমাণের জন্য খুব বেশি সংখ্যক সাক্ষীর প্রয়োজন হয় না। ডজন ডজন সাক্ষীর প্রয়োজন হয় মিথ্যা ঘটনাকে সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে নির্দোষ ব্যক্তিকে সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে। (চলবে)।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন