ছাত্রদল নেতা নুরুর ছোট মেয়ের বয়স এখন প্রায় ৪ বছর। বাবাকে খোঁজার বয়স হয়েছে তাঁর। নুরুকে যখন ঘর থেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল পুলিশ তখন ওই সন্তানের বয়স ছিল ৪ মাস। এই কন্যা সন্তানটি এখন বড় হয়েছে। হাটতে ফিরতে বাবাকে খুঁজেন। মা’র কাছে জানতে চায় বাবা কোথায়? কাকে এখন বাবা বলে ডাকবে? বাবা কেন নেই? এরকম নানা প্রশ্ন করেন। উত্তরে কি বলবেন মা এই শিশুকে? কিভাবে বুঝাবেন পুলিশ ধরে নিয়ে খুন করেছে বাবাকে। কি অপরাধ ছিল? এই প্রশ্নের উত্তরে কি বলবেন মা?
পুলিশ ধরে নিয়ে খুন করার আগে পালিয়েই থাকতেন বেশিরভাগ সময়। অপরাধ ছাত্রদলের সক্রিয় রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট। তাই পুলিশ-র্যাবের ভয়ে বাড়িতে থাকা হত না তেমন। পালিয়ে এখানে-সেখানে কাটাতেন সময়। তারপরও রেহাই হয়নি তাঁর। সেই পুলিশই তাঁকে ধরে নিয়ে খুন করেছে।
শেখ হাসিনার গুম-খুনের রাজনীতির আজকের পর্বে আমরা বলছি, জাতীয়তবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতা নুরুল আরম নুরুকে খুনের ঘটনা।
দিনটি ছিল ২০১৭ সালের ৩০ মার্চ। রাত প্রায় ১২টা। পুলিশ জানতে পেরেছে নুর ওই রাতে বাসায় ফিরেছেন। তখনই চট্টগ্রাম শহরের চন্দনপুরার বাসায় জমদূত হয়ে হানা দেয় পুলিশ। ছোট ৩ সন্তান, স্ত্রী ও এক ভাগনার সামনে থেকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায় নুরুকে। কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাঁকে। ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় বাসায় উপস্থিত ছিলেন ভাগনা রাশেদুল ইসলাম। তিনি পরবর্তীতে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, সাত-আটজন সিভিল পোশাকে এবং তিন-চারজন ছিল পুলিশের পোশাকে। তাদের সবার হাতে ছিল শটগান এবং চাইনিজ বন্দুক। প্রথমে দরজায় নক করেন তারা। এক পর্যায়ে দরজা খোলা হলে, কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নুরুকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এমন বর্ণনাই গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন তখন প্রত্যক্ষদর্শী রাশেদ।
পরিবারের পক্ষ থেকে রাতেই থানা ও র্যাব অফিসসহ সংশ্লিষ্ট জায়গা গুলোতে খোঁজা হয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তখন অস্বীকার করেন।
তবে পরের দিনই অভিযোগ করা হয়েছিল, রাউজান থানার নোয়াপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক (এসআই) শেখ জাভেদের বিরুদ্ধে। বলা হয়েছিল, শেখ জাভেদের নেতৃত্বে চন্দপুরার বাসা থেকে নুরুকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তখন রাউজান থানার ওসি ছিলেন কেফায়েত উল্লাহ। যদিও তিনি নুরুকে ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা বরাবরই অস্বীকার করেছিলেন তখন। ওই সময় চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার ছিলেন নুরে আরম মিনা।
কি ঘটেছিল নুরুর ভাগ্যে:
পুলিশ নুরুকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ৬ ঘন্টার মধ্যেই হত্যা করা হয়। রাষ্ট্রীয় খুনি বাহিনী নুরুকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই বাসায় হানা দিয়েছিল। হত্যার পর লাশ কণফুলীর তীরে রাউজান উপজেলার খেয়োপাড়া খেলাঘাট ফেলে রাখা হয়। সকালে পরিবারের সদস্যরা খবর পান মৃতদেহ পড়ে আছে খেয়োপাড়া খেলাঘট এলাকায়।
মৃতদেহের হাত ও পা নাইলনের দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। মুখ ও চোখ বাঁধা ছিল কাপড় দিয়ে। হাত, পা, চোখ ও মুখ বেঁধে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল ছাত্রদল নেতা নুরুকে।
রাঙ্গুনিয়া সার্কেলের দায়িত্বে থাকা তৎকালীন সিনিয়র সহকারি পুলিশ সুপার জাহাঙ্গির আলম তখন গণমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছিলেন বিষয়টি অনুসন্ধান করে দেখা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়ে নিহত হওয়া নুরু হত্যা তদন্তে রাঙ্গুনিয়া সার্কেলের দায়িত্বে থাকা সিনিয়র সহকারি পুলিশ সুপারের সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তদন্তের ফলাফল আজো জানা যায়নি।
বরং রাউজান থানার ওসি কেফায়েত উল্লাহ তখন উল্টা নুরুর বিরুদ্ধেই অভিযোগ করেছিলেন। সাংবাদিকদের কাছে ওসি দাবী করেছিলেন নুরের বিরুদ্ধে ৪টি মামলা রয়েছে।
মামলা থাকলে বিচার হতে পারত। কিন্তু ধরে নিয়ে হত্যা করার মত জঘন্য মানবতা বিরোধী এই কর্মের দায় কি পুলিশ এড়াতে পারবে?
এদিকে নুরুকে হত্যার ৫ দিন পর পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামী করে একটি মামলা দায়ের করেছিল। তবে ওই মামলারও তদন্ত নিয়ে নানা নাটকীয়তা হয়েছে। তবে ওই ঘটনার পরপরই বিএনপি নেতা গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী এসআই জাভেদের নাম উল্লেখ করেই অভিযোগ করেছিলেন, পুলিশ তাঁকে ধরে নিয়ে গেছে। বিএনপি’র আরেক নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান তখন এই ঘটনার জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবী করেছিলেন। নুরুকে ধরে নিয়ে হত্যার প্রতিবাদে ছাত্রদল চট্টগ্রামে একদিন হরতালও পালন করেছিল তখন। কোন কিছুতেই সুরাহা মিলেনি।
প্রশ্ন হচ্ছে নুরুর ৩ এতিম শিশুর কাছে কি জবাব দেবে রাষ্ট্র?
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন