ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা
আমি গরীব, সংসদে প্রবেশ করিয়াছি বাই-প্রডাক্ট রূপে। ক্ষীণকায় ছয়জন মাত্র সদস্যকে অতি দয়া পরবশ হইয়া নির্বাচিত করিবার ফল স্বরূপ একটি সংরক্ষিত নারী আসন পাইয়াছিল বিএনপি। সেই সুবাদে দলের সিদ্ধান্তে আমার প্রবেশ। সুতরাং যে কোনও অধিবেশনের আগেই বক্তব্যের জন্য ২/৪ মিনিট বাড়াইবার লক্ষ্যে আমার ছুটাছুটি লক্ষ্যনীয়।
পল, অনুপল বাড়াইবার তীব্র উদ্বেগ লইয়াও আমি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করিলাম,সরকারদলীয় জনৈক সাংসদ তাহার বক্তব্যে সংসদে দাঁড়াইয়া পদ্মা সেতুর সহিত তাহার কথোপকথন বয়ান করিতেছেন। নানাবিধ কারণে শুরু থেকেই পদ্মা সেতু আমার নিকট এক বিপুল বিস্ময়। একে তো কাজ শুরু হইতে না হইতেই এই সেতু তৎকালীন সচিবকে জেলে পুরিয়াছিল, মন্ত্রী মহোদয়ের মন্ত্রিত্ব খাইয়াছিল। তারপরে কালে কালে এই সেতু সরকারের প্রধান রাজনৈতিক হাতিয়ার হইয়া উঠিল।
সাংসদের এই কথপকথনে আমিও কিঞ্চিৎ আশাবাদী হইলাম, কে জানে আমার সহিতও কথা কইয়া উঠে কিনা। আমি অবলা মেয়েমানুষ, প্রাণ চাহিলেই পদ্মা পারে ছুটিতে পারি না, উহার উপরে করোনাকাল।
সব মিলিয়া ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়া গুগল করিয়া পদ্মা সেতুর একখানা ছবি লইয়া দেখিতে দেখিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলিতে লাগিলাম। হঠাৎ মনে হইল কে যেন কথা কহিয়া উঠিতেছে। কথা শুনিয়া আমি তো প্রথমে ভীত, পরে শিহরিত হইলাম।
অবাক বিস্ময়ে দেখিলাম ছবি হইতেও সেতু আমার সহিত যোগাযোগের চেষ্টা করিতেছে। সান্ত্বনা দিয়া বলিতেছে, আমি জাতির গর্ব, জাতির সবচাইতে বড় সেলিব্রিটি - প্রতিটা স্প্যান বসাইবার আগে এবং পরে খবর হইলেও আমার মধ্যে অহংকারের লেশমাত্রও নাই। তুমি দুইখানা মনের কথা বলিতে চাও জানিয়া আমিই তোমার নিকট ছুটিয়া আসিয়াছি। তদুপরি এই মহান গণতান্ত্রিক দেশে বিরোধী দলীয় সাংসদ গরীব হইলেও উহার মনের ভাব প্রকাশের পুর্ণ অধিকার রহিয়াছে। বলো কি জানিতে চাও তুমি।
আমি প্রশ্রয় পাইয়া কিঞ্চিৎ সাহসী হইয়া উঠিলাম। আমাদের কথোপকথন আগাইতে লাগিলু। আমি উহাকে শুধাইলাম তুমি কি কেবলই সেতু? ইট, পাথর আর কংক্রিটের স্ট্রাকচারমাত্র? প্রশ্ন শুনিয়াই সেতু ফুঁসিয়া উঠিল। কহিল কোথাকার কোন গর্দভ হে তুমি? আমার নির্মাণ ব্যয় সম্পর্কে কিছুমাত্র ধারণা রাখ কি? রাখিলে কী করিয়া তুমি বল শুধু ইট, পাথর আর কংক্রিট দিয়া আমি তৈরি? এইগুলির পরতে পরতে স্বর্ণকণিকা, হীরক খণ্ড, মণি-মুক্তা সহযোগে পোক্ত করা হইয়াছে বলিয়াই না আমার ব্যয় গগণচুম্বী হইয়াছে। এই বিষয়ে সম্যক না জানিয়াই তুমি বোকা বালিকা টক শো আর কলামে বিস্তর বকবক করিয়াছ।
আমি লজ্জিত হইলাম, কহিলাম – অর্থ যোগাইল কে? বিশ্বের তাবৎ মোড়ল দাতাগণ তো আগেই মুখ ঘুরাইয়া লইয়াছিল। দুষ্ট লোকে দুর্নীতির অপবাদ দিতেও ছাড়ে নাই। সেতু ঝামিয়া উঠিল, লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন। গৌরি সেন থাকিলে ৬ হাজার টাকায় বালিশ, ১০ হাজার টাকায় বটি, ১ হাজার টাকায় কাঁটা চামচ, ৩ লাখ ৩২ হাজার টাকায় দুধে পানি মাপার যন্ত্র, ৫,৫৫০ টাকায় তালা, ৮৫ হাজার টাকায় একটা মেডিকেল বই, ৩৭ লাখ টাকায় পর্দা, ১৫ লাখ টাকায় টেলিফোন খরিদ করা যায়। সেখানে আমার মতন রত্ন খচিত দুর্লভ এক সেতুর নির্মাণ ব্যয় লইয়া তুমি নির্বোধ মাতামাতি করিতেছ। ওহে অর্বাচীন একবারের তরেও কি ভাবিয়াছ, এত বড় সেতু খাড়া হইয়া গেল, অথচ ইহার নামকরণ লইয়া প্রশিক্ষণ লইতে, সুচারুরূপে সিমেন্ট এর সহিত বালি মিশ্রিত করা শিখিতে, গণমাধ্যম কর্মীদিগকে স্প্যান বসানোর খবর সঠিকভাবে পরিবেশনের জন্য প্রস্তুত করিতে, মিডিয়া বিষয়ক প্রশিক্ষণ লইতে এখন পর্যন্ত কোনও কর্মকর্তা বিদেশ ভ্রমণ করেন নাই। সুতরাং সার্বিক বিবেচনায় অগ্র পশ্চাৎ ভাবিলে আমি ক্ষমতাসীনদের জন্য যে পরিমাণ রাজনৈতিক ফায়দা লইয়া আসিয়াছি, সেই তুলনায় আমার ব্যয় কি নেহায়েতই তুচ্ছ নহে?
আমি ভয়ে ভয়ে পুনয়ার প্রশ্ন করিলাম, ২০০৮ এ তুমি ক্ষমতাসীনদের মগজে স্থান করিয়া লইয়াছিলা। লোক সন্মুখে দৃশ্যমান হইতে তোমার এতকাল লাগিল কিরূপে? সেতু পাল্টা জিজ্ঞাসিল, আমি কি যেমন তেমন নদীর উপর বসিতেছি? ইহা এক আশ্চর্য নদী। ইহার তলদেশের স্থানে স্থানে আছে ব্ল্যাকহোল, পিয়ার তৈরির সময় নিমজ্জিত হইয়া যায় সে কারণে পিয়ার এর নক্সা বারংবার পরিবর্তিত হওয়াই কি সমীচীন নহে? ওইদিকে রেল সংযোগের ক্ষেত্রে জাজিরা পয়েন্টে লরির মস্তক রেললাইনের পশ্চাতে ঠেকিয়া যাইবার যে সমস্যা হইয়াছে উহা হইয়াছে বিরাট কর্মযজ্ঞের ফলে সৃষ্ট অবসাদের কারণে। উহারও সমাধান হইবে নিশ্চয়। লাগুক সময় হউক অর্থ ব্যয়। কোনটাই কোন সমস্যা নয়।
সেতুর বাকচাতুর্যে ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়া সভয়ে বলিয়া ফেলিলাম, ঘরের পাশে আসাম আর অরুণাচলের মধ্যে ৯.২৫ কিলোমিটারের ভূপেন হাজারিকা সেতুটি তৈয়ার হইয়াছে, উহা এত কম ব্যয়ে নির্মিত হইল কীরূপে? তোমার খরচে তো উক্ত সেতুর মত অন্তত ২৫ খানা সেতু নির্মাণ সম্ভব।
মুচকি হাসিয়া সেতু কহিল, ভুলিয়া যাইয়ো না বৎস ইহা বাংলাদেশ। এখানে ঘর ঘাঁটিলে হাজার কোটি টাকার কাগজ মেলে, এখানে এক জেলা শহরের আওয়ামী লীগ নেতা বিদেশে ২ হাজার কোটি টাকা স্থানান্তর করে, এক থানার যুবলীগ নেতা সহদরগণ এই ঢাকা শহরেই শ এর উপর আবাসস্থলের মালিক হয় সেখানে হৃষ্টপুষ্ট, লম্বা একখানা আস্ত সেতু নির্মিত হইয়া যাইবে সেতু এবং ব্যক্তির ওজন মাফিক নজরানা না দিয়াই?
এইবার যখন তাহাকে এই বিপুল ব্যয়ের সহিত সম্পর্কিত দুর্নীতি লইয়া প্রশ্ন করিতে ধরিলাম, সে চমকিয়া উঠিল। ভালমত ঠাহর করিয়া বলিল, ওহে কথা বলিতে বলিতে আমি খেই হারাইয়া ফেলিয়াছিলাম, এখন নজর করিয়া বুঝিলাম, তুমি বিরোধী দলের অর্বাচীন, বাচাল সদস্যটি, নও? আমি আর কী বলিব, সে বলিয়া চলিল, এই সেতু যাহার মনে এত প্রশ্নের উদ্রেক করে, সে স্বাধীনতার চেতনা বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষশক্তি। উন্নয়নের মহাসড়কের যাত্রা তাহার জন্য নহে। আমি তোমার সহিত বাক্যালাপে মত্ত হইয়াই ভুল করিয়াছি বাপু। আর একটি বাক্যও নহে।
এই বলিয়া ঝামটা মারিয়া সেতু মুখ বন্ধ করিল। আমি আর কী করিব, বিরস বদনে বসিয়া ভাবিতে লাগিলাম সংসদে বক্তব্যের সময় আর দুই মিনিট কি করিয়া বাড়াইয়া লওয়া যায়।
লেখক: সংসদ সদস্য, আইনজীবী।
মতামত লেখকের নিজস্ব
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন