শাহবাগ থেকে আবারো ফ্যাসিবাদি হুঙ্কার দেওয়া হয়েছে। ফ্যাসিবাদের ক্রীড়নকরা ২০১৩ সালের মত আবারো শাহবাগে জমায়েত হয়ে হুঙ্কার ছুড়েছেন। দেশের কোন সঙ্কটে এদের দেখা না মিললেও ভারতীয় সংস্কৃতির স্বার্থে মঙ্গলবার (১ ডিসেম্বর) এদের দেখা পাওয়া গেছে ফ্যাসিবাদি চত্বর হিসাবে পরিচিত এই জায়গাটিতে। অতি সম্প্রতি ছাত্রলীগের ধর্ষণ নিয়ে দেশব্যাপি ফুঁসে উঠেছিল মানুষ। ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন লাখো জনতা। ধর্ষণের পাশাপাশি দুর্নীতির হাজারো সংবাদ ভাইরাল হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ছাত্রলীগের ফরিদপুর জেলা সভাপতির দুই হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার, ছাত্র লীগ কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীদের হাতুড়ি পেটা করাসহ সন্ত্রাস রাহাজানির খবর ভাইরাল হচ্ছে প্রায়ই। এনিয়ে কখনো কথা বলতে দেখা যায় না এই চহ্নিত গোষ্ঠীকে। অথচ, শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যের নামে মূর্তি নির্মান প্রসঙ্গে বক্তব্য দেয়ায় হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে এরা সরব হয়ে উঠেছেন। ৯০ শতাংশ মানুষের ধর্মীয় সংস্কৃতির বিরোধী ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতীক মূর্তির পক্ষে কঠোর অবস্থান ব্যক্ত করতে ফ্যাসিবাদী হুঙ্কার দিচ্ছেন। সদল বলে রাজপথে নেমে এসে ফ্যাসিবাদের পক্ষে তাদের অবস্থানের জানান দিয়েছেন। ভাস্কর্যবিরোধী বক্তব্য প্রত্যাহার না করলে পরিনাম ভাল হবে না বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন হেফাজতে ইসলামকে।
এই একই গোষ্ঠীর লোকজন ২০১৩ সালের ফ্রেব্রুয়ারী শাহবাগ চত্বর থেকে ফ্যাসিবাদের জয়ধ্বনী করেছিলেন। ভিন্নমতকে পিষে মারতে লাঠিমিছিলও বের করেছিলেন এরাই। বিচারের বদলে ফাঁসি চাই শ্লোগান দিয়ে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন এই একই গোষ্ঠী। এবার তারা শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি নিয়ে ফ্যাসিবাদি হুঙ্কার ছুঁড়ে পূর্বেও মতই মাঠে নেমেছেন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় । ভারতীয় সংস্কৃতির স্বার্থে যখনই আঘাত লাগে তখনই এদেরকে সরব হতে দেখা যায়।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি নামক সংগঠনের উদ্যোগে মূর্তি নির্মানের পক্ষে মানববন্ধন আয়োজন করা হয়েছিল মঙ্গলবার (১ ডিসেম্বর)। শাহবাগে আয়োজিত মানববন্ধনের প্রধান দাবী ছিল মূর্তি নির্মানের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেয়ায় হেফাজতে ইসলামীর আমীর আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী ও যুগ্ম মহাসচিব আল্লামা মামুনুল হককে গ্রেফতার করতে হবে।
শাহবাগে আয়োজিত মানববন্ধনে যোগদেন সরকারের মন্ত্রিরাও। মুন্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এই মানববন্ধনে উপস্থিত হয়ে হুশিয়ারি দিয়েছেন হেফাজতে ইসলামকে। তার ভাষায় ভাস্কর্য বিরোধী বক্তব্য প্রত্যাহার না করলে হেফাজতে ইসলামের পরিনাম ভাল হবে না। তিনি বলেন, মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য দেওয়ার পরেও এখনও তাদের নিয়ে কিছু বলা হয়নি। এটাই আপনাদের সৌভাগ্য। দৃষ্টান্তমূলক পরিণামের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির দেয়া তথ্য অনুযায়ী তাদের কর্মসূচিকে সমর্থন জানিয়ে আরো যেসব সংগঠন মানববন্ধনে অংশ নিয়েছে তারা হলেন-সেক্টরস কমান্ডার্স ফোরাম, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, সম্মিলিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা অ্যাসোসিয়েশন, পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, প্রজন্ম ’৭১, বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউট, বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াও, বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান ঐক্য পরিষদ, ইতিহাস সম্মিলনী, জাতীয় কবিতা পরিষদ, সম্প্রীতি বাংলাদেশ, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, জাতীয় কবিতা পরিষদ, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদ, বাংলাদেশ গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ সঙ্গীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থা, বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বঙ্গবন্ধু গবেষণা সংসদ, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, বাংলাদেশ যুব মৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (জাসদ), জাতীয় যুব জোট, ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউট বাংলাদেশ কেন্দ্র, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলন, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ, ’৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রবর্তন জাতীয় কমিটি, কেন্দ্রীয় খেলাঘর, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ কেন্দ্র, মুক্তিযুদ্ধ সংহতি পরিষদ, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ), বাংলাদেশ ফার্মাসিস্ট ফোরাম, গৌরব ’৭১, অপরাজেয় বাংলা, মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতি পাঠাগার, কর্মজীবী নারী, জাতীয় নারী জোট, নারী মুক্তি সংসদ, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ, শেখ রাসেল ফাউন্ডেশন ইউএসএ (বাংলাদেশ চাপ্টার), জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ মোর্চা, সেক্যুলার ইউনিটি বাংলাদেশ, ইউথ ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, আওয়ামী প্রজন্ম লীগ, মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ, ঘাসফুল শিশু কিশোর সংগঠন, বাংলাদেশ মানবাধিকার আন্দোলন, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ আন্দোলন বাংলাদেশ।
প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের মানুষের ভোটাধিকার হরণ, অব্যাহত ধর্ষণ, নারীর প্রতি সহিংসতা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডসহ বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় দেশের মানুষ প্রতিবাদ জানালেও তাদের দেখা মিলে না কেন? শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ কায়েমের মূল শক্তি হচ্ছে ভারতীয় সংস্কৃতির এজেন্ট হিসাবে পরিচিত এসব সংগঠন গুলো। ধর্ষণ, নারীর প্রতি সহিংসতা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, লুটপাট ও দেশের টাকা বিদেশে পাচারে নীরব থেকে এদের রয়েছে প্রত্যক্ষ সমর্থন। কোন কোন অপরাধের সাথে এরা নিজেরাও জড়িত। ভারতীয় সংস্কৃতির স্বার্থ বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসাবে এদেরকেই সময়ে সময়ে মাঠে নামায় শেখ হাসিনা।
মঙ্গলবারের মানববন্ধন কর্মসূচি থেকে অবিলম্বে হেফাজতে ইসলামের আমীর জুনাইদ বাবুনগরী, যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হককে গ্রেপ্তাররের পাশাপাশি ইসলামী রাজনীতিকে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক আখ্যায়িত করে নিষিদ্ধ করার দাবি জানান আয়োজকরা।
কর্মসূচিতে ভারতীয় সংস্কৃতির ধারক সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, আমরা মনে করি, ভাস্কর্যের সঙ্গে ধর্মের কোনো বিরোধ নেই। কাজেই যারা বাংলাদেশে ভাস্কর্যের সাথে ধর্মের সাংঘর্ষিক অবস্থান তৈরি করছে, এটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমরা দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করার এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করার সব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সভাপতি, কট্টর ইসলাম বিদ্বেষী হিসাবে পরিচিতি নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, সম্প্রতি যা ঘটছে বাংলাদেশে, সবচাইতে এলার্মিং ঘটনাট হচ্ছে, জাতির পিতার ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলে নদীতে ছুঁড়ে ফেলার মতো ধৃষ্টতা তারা দেখিয়েছে। তারা কোনো অবস্থাতেই ভাস্কর্য করতে দেবে না বলেছে। কারা বলছে? তারা কারা ? তারা হচ্ছে একাত্তরের পরাজিত সৈনিক, একাত্তরের পরাজিত শত্রু, তাদেরই উত্তরসূরি, একেবারেই তাদের প্রতীকী রূপ। মামুনুল হক থেকে শুরু করে চরমোনাই পীরের ছলে বাবুনগরী, প্রতিটা লোকের সূত্র হচ্ছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিরোধিতা করা।সামাজিক-সাংস্কৃতিক শক্তির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মৌলবাদী শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে এখন প্রগতিশীলতার বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিচ্ছে।
একাত্তরের পরাজিত শক্তির দোসরদের যথোপযুক্ত শাস্তির দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের অবস্থান খুব পরিষ্কার। একাত্তরে তাদের অনেককেই পরাজিত করলেও যথাযোগ্য শাস্তি দেইনি। তাদের যে শাস্তি দেওয়া উচিৎ ছিল, সেটা দেওয়া হয়নি সেটার নানা কারণ আছে।
তিনি বলেন,তারা এত বছর ধরে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে, মানুষকে ভুল বুঝিয়ে এসেছে। এটা স্পষ্টভাবেই বলতে চাই, তারা বাংলাদেশকে একটা তালেবানি রাষ্ট্র করতে চায়। যে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসেছে, সেই বাংলাদেশ কখনও পাকিস্তানি, আফগানিস্তানি বা তালেবানি রাষ্ট্র হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রগতিশীল সংগঠনগুলোর এই ধরণের বক্তব্যের বিরুদ্ধে একত্রিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
গত ৭ নভেম্বর চট্টগ্রামের সমাবেশ ও মিাছল থেকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ঘোষণাকারী সাম্প্রদায়িক সংগঠন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার নামে সাম্প্রদায়িক মহল দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির যে চেষ্টাটি করছে, এটি শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
বাংলাদেশ কবিতা পরিষদের সভাপতি মুহাম্মদ সামাদ বলেন, আজকে যে অন্ধ মৌলবাদী শক্তি ভাস্কর্যের বিরোধিতা করছে, তাদের পুলিশি ব্যবস্থায় শাস্তি দিলেই হবে না। তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সচেতন করে তুলতে হবে যেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলো অক্ষয় থাকে।
বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সহ সাধারণ সম্পাদক সঙ্গীতা ইমাম বলেন, আজ আমরা মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপগোষ্ঠীগুলোর যে ধৃষ্টতা দেখছি, তা একদিনে তৈরি হয়নি। একাত্তরের পরাজিত এই অপশক্তিগুলোর প্রতি বারবার নতজানু নীতি প্রদর্শন করেছে বর্তমান সরকার। মুক্তচিন্তার মানুষ হত্যা, পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকীকরণ, সুপ্রীম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য অপসারণসহ নানাবিধ রাজনৈতিক মেরুদণ্ডহীন কর্মকাণ্ডের ফসলই হল জাতির পিতাকে নিয়ে তাদের আজকের এই ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ। উদীচীর দাবি, অবিলম্বে সংবিধান থেকে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ বাতিল করে বাহাত্তরের অসাম্প্রদায়িক সংবিধানে ফিরে যেতে হবে। মৌলবাদের জুজুর ভয়ে রাষ্ট্রের প্রশ্রয়-আপসের অবসান ঘটাতে হবে।
মানববন্ধনে যুবলীগ সভাপতি শেখ ফজলে শামস, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, ইন্ডিয়া পন্থি সাংবাদিক আবেদ খান, মুনতাসীর মামুনসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
প্রত্যেকের বক্তব্যই ছিল ভিন্নমত দমনে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করার জন্য উস্কানিমূলক। তারা ভারতীয় সংস্কৃতির মূর্তি প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে ভিন্নমত দমনের জন্য উস্কানি দিচ্ছে। ৯০ শতাংশ মানুষের ধর্মীয় সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক সারা দেশে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি প্রতিষ্ঠার পাশপাশি ভিন্নমতকে স্তব্ধ করে দিতে মাঠে নেমেছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন