বিএনপিকে নিয়ে খেলছে নির্বাচন কমিশন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিএনপিও এই খেলায় অংশ নিচ্ছে আনন্দচিত্তে। স্থানীয় সরকার কিংবা জাতীয় সংসদের উপ-নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা শুনলেই দলটির এক শ্রেনীর সুবিধাভোগী নেতৃত্ব চাঙ্গা হয়ে উঠতে দেখা যায়। সরগরম হয়ে উঠে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও গুলশানের চেয়ারপার্সনের কার্যালয়। নড়ে চড়ে বসতে দেখা যায় লন্ডনের কিছু ভুঁইফোড় নেতৃত্বকেও। একদিকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত সরকারকে অবৈধ ও ফ্যাসিবাদী হিসাবে আখ্যায়িত করে বক্তব্য দেন বিএনপি’র নেতারা। আরেক দিকে এই অবৈধ ও ফ্যাসিবাদি সরকারের অধীনেই সব উপ-নির্বাচন, উপজেলা ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের খেলায় মেতে উঠে দলটি। আর এতে স্পষ্ট, ফ্যাসিবাদী সরকারের নিয়ন্ত্রিত ও জনগণের অস্থাহীনতায় ভেঙ্গেপড়া নির্বাচনী ব্যবস্থাকে অক্সিজেন দিয়ে বৈধতার লেবাস দেয়াই যেন এখন বিএনপি’র রাজনৈতিক দায়িত্ব। এর পেছনে টাকা পয়সার লেন-দেনের একটা ব্যাপার থাকতে পারে বলেও কেউ কেউ মনে করেন।
শেখ হাসিনার নির্বাচনী খেলায় আস্থা হারিয়ে সাধারণ মানুষ স্বপ্রণোদিত হয়ে ভোটকেন্দ্রে যাওয়া বর্জন করছেন। এটাকে জনতার ভোট বর্জন বললেও কম বলা হবে। জনতার মঞ্চের আমলাখ্যাত হুদা কমিশনের বক্তব্য অনুযায়ী বিএনপি-আওয়ামী লীগ মিলেও ১০ শাতংশের বেশি ভোটার উপস্থিত করতে পারছে না কেন্দ্র গুলোতে। তাদের ডাকে সারা দিচ্ছেন না মানুষ। ২০১৪ সাল থেকেই মানুষ ভোটকেন্দ্র বিমূখ। এমনকি ভোটের দিন মাইকিং পর্যন্ত করা হয় কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেয়ার জন্য। মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে আহ্বান জানানো হয় কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে। তারপরও মানুষ ডাকে সারা দেয় না। কিন্তু বিএনপি ঠিকই সরব হয়ে নির্বাচন কমিশনের খেলায় অংশ নেয়। নির্বাচন কমিশন ও শেখ হাসিনার নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনী প্রহসন সাধারণ মানুষ বুঝলেও বিএনপি যেন বুঝতে নারাজ। অতি সম্প্রতি অুনষ্ঠিত ঢাকা-৫ এবং নওগাঁ-৬ উপ-নির্বাচনের পর বিএনপি মহাসচিব নিজেও সংবাদ সম্মেলনে দাবী করেছেন, ৫ শতাংশের বেশি ভোটার কেন্দ্রে আসেনি। তাঁর এ বক্তব্যে নিজেই প্রমাণ করলেন মানুষ তাদের ডাকে সারা দেয়নি । অর্থাৎ রাজনীতিতে জনগণ বিএনপি থেকে এগিয়ে রয়েছেন। তারপরও নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলেই অংশ নেওয়া রেওয়াজে পরিণত হয়েছে বিএনপি’র।
বিএনপি মহাসচিব গতকালও (২০ অক্টোবর) ঠাকুরগাঁওয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, বর্তমান সরকার নির্বাচনকে তামাসায় পরিণত করেছেন। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, এই তামাসাকে আরো আন্দদায়ক বা উপভোগ্য করে তুলতেই কি বিএনপি হুদা কমিশনের নির্বাচনী খেলায় অংশ নিচ্ছে? বিএনপি মহাসচিব আরো দাবী করেছেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর দশম জাতীয় সংসদের একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়েছে। এখান প্রশ্ন আসে মহাসচিবের ভাষায় ধ্বংস হওয়া নির্বাচনী ব্যবস্থায় কেন তারা ২০১৪ সালের পর থেকে বারবার অংশ নিচ্ছেন?
স্থানয়ী সরকারের নির্বাচন বা জাতীয় সংসদের উপ-নির্বাচন এলেই দেখা যায় মনোনয়ন নেয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয় দলটির এক শ্রেনীর নেতকর্মীর মাঝে। কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও গুলশানের চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ের সামনে ঘটে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা। দলীয় মনোনয়নের প্রত্যাশায় কিছু মানুষের দৌড়ঝাপ ও মারামারিকে দলটির কতিপয় নেতা নির্বাচনে অংশগ্রহনের পক্ষে যুক্তি খাড়া করেন। তারা বোঝাতে চান, মানুষের আগ্রহ রয়েছে নির্বাচনের প্রতি। নির্বাচন এলে দলীয় নেতাকর্মীরা চাঙ্গা হয়। দলের পক্ষ থেকেও তখন যুক্তিখাড়া করে বলা হয়, গনতন্ত্রের ন্যূনতম স্পেস কাজে লাগাতে চায় বিএনপি। নির্বাচন হচ্ছে গণতন্ত্রের অন্যতম একটি মাধ্যম। মনোনয়ন প্রাপ্তি নিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের মল্লযুদ্ধের মাঝেও দলটির কতিপয় নেতা চাঙ্গাভাব খুঁজে বেড়ান। তবে মনোনয়ন প্রাপ্তিতে লেন-দেন নিয়েও বাজারে নানা কথা বাতাসে ভেসে বেড়ায়। দলটির এক শ্রেনীর নেতাকর্মী মনে করেন, নির্বাচনে অংশ নেয়ার মাধ্যমে একটি মহল অর্থিক লাভবান হয়ে থাকেন।
নির্বাচনী খেলায় বিএনপিকে ক্ষণিকের জন্য আনন্দ দিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলটিকে কোথায়ও একটি পদে বিজয়ী করে দেয় হুদা কমিশন। ছিটেফোটা বিজয়ের মাধ্যমে শেখ হাসিনার মনোনীত হুদা কমিশন নির্বাচনী খেলাকে আরো জমিয়ে তোলার চেষ্টা করে। বিএনপির কতিপয় নেতাকর্মী তখন ফ্যাসিবাদি সরকারের অধিনে নির্বাচনে অংশ নেয়ার যৌক্তিকতা খুঁজেন। এক বিজয়ে বাকী সব জায়গায় পরাজিত হওয়া বা নির্বাচনের মাঠে প্রচারণায় নামতে না দেয়া ও ভোটকেন্দ্রে এজেন্ট উপস্থিত করতে না পারার বিষয়টি বেমলুম ভুলে যান তারা। দেশের কোন এক প্রান্তে উপজেলা বা পৌর নির্বাচনে বিজয়ের ফলে স্থানীয় নেতাকর্মীরা কিছুটা লাভবান হন, কিন্তু পুরো দেশের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ ফ্যাসিবাদি নির্যাতন আর শোষণের শিকার হতেই থাকেন। এটা এক প্রকারের দ্বিচারিতা। নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নূতন মামলা থেকে বাঁচার অজুহাত দিয়ে বিএনপি বড় রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে বিরত রয়েছে দীর্ঘ অনেক বছর। অথচ উপ-নির্বাচন বা স্থানীয় নির্বাচনে অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে নূতন মামলা হয়। পুরাতন মামলা চাঙ্গা করা হয়। নির্বাচনে অংশ নিয়ে নূতন মামলাকে নির্বাচনী খেলার অংশ হিসাবেই মনে করে থাকে দলটি।
এখানে উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ২০১৮ সালের জুলাই মাসে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে বিজয়ের বিষয়টি। দেশের সব সিটি কর্পোরেশনে হুদা কমিশন স্টাইলে ভোট ডাকাতির ঘটনা ঘটলেও সিলেটে বিজয় পায় বিএনপি। এই বিজয়ে অনেকে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলতে থাকেন যে, সারাদেশে একদিনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ভোট ডাকাতি করা শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না। ভোটকেন্দ্রে জনগণ উপস্থিত হলে নিয়ন্ত্রণের জন্য এত পুলিশ ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পাবেন না শেখ হাসিনা। প্রশাসনও তখন তাঁর কথা শুনবে না। এ প্রসঙ্গে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনকে সামনে এনে উদাহরণ দিতে শোনা যেত তাদের মুখে। অথচ তারা ভুলে যান যে, ২০১৮ সালে একদিনের নির্বাচনের মাধ্যমেই ভোটের আগের রাত্রে হাসিনার পক্ষে ফলাফল পাল্টে দেয়া সম্ভব হয়েছিল। বিএনপি’র এই চিন্তা চেতনাকে রাজনৈতিক দেওলিয়াত্ব ছাড়া আর কি-ই বা বলার থাকতে পারে।
নির্বাচনী খেলায়, রকিব কমিশন থেকে হুদা কমিশন:
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর একতরফা জাতীয় নির্বাচনের পর থেকেই শেখ হাসিনা ও নির্বাচন কমিশন বিএনপিকে নিয়ে রীতিমত খেলায় মেতে উঠে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর জাতীয় নির্বাচন ও পরবর্তী স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোট হয় কাজী রকিব উদ্দিন আহমদের নিয়ন্ত্রিত কমিশনের অধীনে। রকিব কমিশনই ভোটের মাঠে বিএনপিকে নিয়ে খেলা শুরু করেছিল। ২০১৪ সালের জানুয়ারীতে ভোটারবিহীন একতরফা জাতীয় নির্বাচনের মাসেই শুরু হয় উপজেলা নির্বাচন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে জাতীয় নির্বাচন বর্জনের পরপরই শেখ হাসিনার অধীনে উপজেলা নির্বাচন অংশ নেয় বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন জোট। খেলা জমিয়ে রাখতে রকিব কমিশন উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন জোটের অনেক প্রার্থীকে বিজয়ী হওয়ার সুযোগ দেন। কিন্তু শেষের দুই ধাপে আসল রূপে আবির্ভূত হয় রকিব কমিশন। তখনই নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার কারিগর হিসাবে কাজী রকিব উদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল।
কাজী রকিব উদ্দিনের পর জনতার মঞ্চের আমলা নুরুল হুদাকে খুঁজে নেয়া হয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসাবে। হুদা কমিশন গঠনের পর বিএনপি’র অনেক নেতাকে বলতে শোনা যায় যে, এই হুদা কমিশন নাকি ২০০১ সালের সাঈদ কমিশন রূপে আবির্ভূত হতে যাচ্ছেন। বিএনপি’র সুবিধাবাদি আন্দোলন বিমূখ নেতাদের খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠতে দেখা গিয়েছিল। অথচ, পরবর্তীতে দেখা যায় বিএনপিকে নিয়ে নির্বাচনী খেলায় রকিব কমিশনকে ছাড়িয়ে যায় হুদা কমিশন। রকিব কমিশন ২০১৪ সালে বিএনপিকে নির্বাচন আনতে ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু হুদা কমিশন অত্যন্ত সফলতার সাথে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনে বিএনপিকে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। জাতীয় নির্বাচনে নিয়ে এসে ৬টি আসন ধরিয়ে দেয়। এই হুদা কমিশন পরবর্তী সব উপ-নির্বাচন এবং স্থানীয় নির্বাচনেও বিএনপিকে নিয়ে খেলছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। এবং এই খেলার সাথে বিএনপি’র বর্তমান নেতৃত্ব সোৎসাহে যোগ দিচ্ছেন।
ফ্যাসিবাদের ভোটের খেলা সাধারণ মানুষের বর্জন:
গত মঙ্গলবার (২০ অক্টোবর) ১৯২টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সব গুলোতেই বিএনপি দলীয়ভাবে অংশ নিয়েছে। বিএনপি-আওয়ামী লীগের অংশ নেয়ার পরও নির্বাচনী খেলায় সাধারণ মানুষ সারা দেয়নি। নির্বাচনী এলাকা গুলোর ভোট কেন্দ্রে মানুষের উপস্থিতি ছিল একেবারেই কম। মঙ্গলবারের এই নিবাচন গুলোর ভোট কেন্দ্রে মানুষের অনুপস্থিতি নিয়ে বিবিসি বাংলায়-‘বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে আস্থার সঙ্কট, দায় কার? নির্বাচন কমিশন নাকি রাজনৈতিক দলগুলোর?’ শিরোণামে একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা যায় ভোটাররা কেন্দ্রে যেতে আগ্রহী নয়। প্রতিবেদনটিতে উদাহরণ হিসাবে পাকইগাছা উপজেলার কয়েকটি কেন্দ্রের উদাহরণ দিয়ে বলা হয়, বেলা ১২টায় ৩০০০ ভোটারের কেন্দ্রে ভোট পড়েছে মাত্র ১৫-২০টি। প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয় ভোটকেন্দ্র গুলো জনশূন্যতায় খাঁ খাঁ করছিল।
অনুরূপ দৃশ্য দেশের সব নির্বাচনী এলাকায়। জনগণ স্বপ্রণোদিত হয়ে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের অধিনে নির্বাচনী খেলা বর্জন করলেও বিএনপি সেই খেলায় অংশ নিচ্ছে। এই সুযোগে বিএনপিকে নিয়ে নির্বাচনের নামে প্রহসনে খেলছে সরকারও নির্বাচন কমিশন। এজন্যই হয়ত আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল বলেছেন, বিএনপি’র সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হচ্ছে জনগণের মনের ভাষা বুঝতে না পারা।
প্রকৃত পক্ষে বিএনপি জনগণের বিরুদ্ধে গিয়ে দিল্লীর ইঙ্গিতে ফ্যাসিবাদের দোসরে পরিণত হয়েছে। অধিকন্তু বর্তমান সময়ে ধর্ষণ বিরোধী এবং সরকারের অন্যান্য দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে জনগণ মাঠে নামলেও বিএনপি নেতাদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের বাইরে তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন