স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠি। এ চিঠির মাধ্যমেই সরকারি অপকর্মের সংবাদ প্রকাশকারীদের হুমকি দেয়া হয়েছে।
সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের অপকর্মের তথ্য গোপন করতে এবার সাংবাদিক ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের হুমকি দিয়ে গণমাধ্যমে এক বিবৃতি পাঠিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মঙ্গলবার (১৩ অক্টোবর) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ দফতরের সিনিয়র তথ্য অফিসার মো: শরীফ মাহমুদ অপু স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ হুমকি দেয়া হয়। এই হুমকির মাধ্যমে সরকারের ফ্যাসিবাদী চরিত্রের বহি:প্রকাশ আবারো ঘটেছে। বর্তমান সেনা প্রধান ও তাঁর বন্ধুর টেলিকথোপকথন, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন ও খুন এবং অব্যাহত ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে সমালোচনার ঝড়ের মধ্যে সরকার এই বিবৃতি প্রকাশ করে। এতে প্রমাণ করে স্বাভাবিক তথ্য প্রবাহ বন্ধের লক্ষ্যেই ফ্যাসিবাদী সরকার হুমকি দিয়েছে।
তবে এবারের হুমকিতে দেশের মানচিত্র অতিক্রম করে, বিদেশে অবস্থানকারী বা নির্বাসনে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে যারা সরকারের দুর্নীতি, দু:শাসন, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও লুটপাটের সমালোচনা করছেন তাদেরকে শায়েস্তা করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ফ্যাসিবাদীদের লক্ষ্য হচ্ছে বিদেশেও যাতে বাংলাদেশের দু:শাসন নিয়ে কথা বলা না হয়। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণকে সঠিক তথ্য জানা থেকে রিবত রাখতেই এ সকল অপকৌশল গ্রহন করেছে ফ্যাসিষ্ট সরকার।
এদিকে দেশের এক শ্রেনীর গণমাধ্যম রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে সহযোগি হিসাবে কাজ করে চলেছে। গণমাধ্যমের বাকী অংশ সরকারে কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। দৈনিক আমার দেশসহ যে ক‘টি গণমধ্যমকে বশ্যতা স্বীকার করাতে ব্যর্থ হয়েছে সে গুলোকে অনেক আগেই জোর করে বন্ধ করে দিয়েছে ফ্যাসিবাদীরা। ফ্যাসিবাদ নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমের উপর আস্থা হারিয়ে মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে তথ্য প্রবাহের সুযোগ হিসাবে নিয়েছিল। এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণের জন্য ইতোমধ্যেই তথ্যপযুক্তি আইন নামে নিবর্তনমূলক কালো আইন তৈরি করেছে। এ আইনের আওতায় ফেইসবুক, টুইটারে সরকারের সমালোচনাকারী ব্যক্তিদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। দেশে পাইকারী ধর্ষণ নিয়ে ফেইসবুকে প্রধানমন্ত্রীর ব্যর্থতার কথা বলায় গত সপ্তাহেও দুই শিক্ষার্থীকে কারাগারে নেয়া হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে। এখন আবার নূতন করে হুমকি দেয়া হল।
গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে সরকারের যত অপকৌশল
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের একটি সমঝোতার (ইন্ডিয়া-মঈন-হাসিনা) নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পরই শেখ হাসিনার সরকার ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠার প্রক্রিয়া শুরু করে। সরকারের চাপের মুখে অধিকাংশ গণমাধ্যম নীরবে আত্মসমর্পণ করে। যারা আত্মসমর্পণে রাজি হয়নি তাদের হয় জোর করে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, নতুবা ভিন্ন কৌশলে টুটি চেপে ধরা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় অপকৌশলের বড় একটি অস্ত্র হচ্ছে সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেয়া। বেসরকারি বিজ্ঞাপন দাতাদেরকেও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক হুমকি দিয়ে ভিন্নমতের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া বন্ধ করা হয় ।
বর্তমান ভার্চুয়াল যুগে অনলাইন গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণেও সরকার নানা কৌশল নিয়েছে। অনলাইন রেজিষ্ট্রেশনের নামে সরকার সমর্থক ব্যক্তিদের ছাড়া অন্য কাউকে অনলাইন গণমাধ্যম চালুর অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। এছাড়া সরকারের কোন আচরণের সাথে ভিন্নমত পোষণ করলে বিটিআরসি (বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন) সরাসরি অনলাইন ব্লক করে দিচ্ছে। এমনকি বিদেশ থেকে ভিন্নমতের কেউ বাংলা অনলাইন নিউজ চালু করলে সেটা বাংলাদেশে ডাউনলোড করা বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। যেমন গত ৩০ আগষ্ট দৈনিক আমার দেশ ইউকে অনলাইন চালু করার ১২ ঘন্টার মধ্যে বাংলাদেশে ডাউনলোড ব্লক করে দিয়েছে বিটিআরসি। অনুরূপভাবে অনলাইন পত্রিকার ডোমেইন বিটিআরসির মাধ্যমে ব্লক করে দিয়ে স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ করা হয়।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সরকারের অনিয়ম, দুর্নীতি, দু:শাসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবর প্রথম থেকেই প্রকাশ করেছে ঢাকার দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা। ২০১০ সালের ১ জুন পত্রিকাটি জোর করে বন্ধ করে দিয়ে সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। বানোয়াট মামলায় রিমান্ডে নিয়ে সম্পাদকের উপর চালানো হয়েছিল নির্যাতন। তখন দেড় মাসের আইনি লড়াইয়ের পর পত্রিকা আবার ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছিল পাঠকের কাছে। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে পত্রিকাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নিয়ন্ত্রিত বিচার নিয়ে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান ও তাঁর বন্ধুর স্কাইপ কথোপকথন ফাঁস করে দেয়। এই কথোপকথনে উঠে এসেছিল সরকার কিভাবে ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ভিন্নমতের রাজনীতিকদের ফাঁসি দেয়ার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিচ্ছে। একই সংবাদ লন্ডনের ইকোমিষ্টেও প্রকাশিত হয়েছিল। ফ্যাসিবাদি সরকার আমার দেশ জোর করে বন্ধ করে দেয় এবং সম্পাদককে আবারো গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালায়। এই জাতীয় নিপীড়নের মাধ্যমেই গণমাধ্যম নিজেদের শতভাগ নিয়ন্ত্রণে নেয়ার ফলে বাংলাদেশের মানুষ সঠিক তথ্য জানা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এরপর থেকে ঢাকায় আমার দেশ চালানো আর সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশে গণমাধ্যমের উপর সরকারি নিপীড়নের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের উদ্বেগ
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গত ৮ অক্টোবর এক বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে জানায়, বাংলাদেশে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের উপর সরকারের ‘নিপীড়ন’ বেড়েছে।
করোনা মহামারীর মধ্যে ভিন্নমত দমনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার তথ্যও তুলে ধরে অ্যামনেস্টি।
এই মানবাধিকার সংগঠন জানায়, ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর এই আইন করার পর থেকে এর আওতায় প্রায় দুই হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮০০ এর বেশি মামলা দায়ের হয়েছে ২০২০ সালের প্রথম নয় মাসে।
উল্লেখ্য, সরকারের এমন ফ্যাসিস্ট আচরণ নতুন নয়। ভিন্নমত সহ্য করতে না পেরে ২০১৫ সালে সরকারি নির্দেশে বাংলাদেশে ২২ দিন ফেসবুক বন্ধ করা হয়েছিল।
এখন নিজেদের অপকর্ম আড়াল করতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে সরকার, জনপ্রতিনিধি, সেনা কর্মকর্তা, পুলিশ কর্মকর্তা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সম্পর্কে ফাঁস হওয়া খবরগুলোকে “অসত্য, বানোয়াট, বিভ্রান্তিকর ও উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রচার” বলে দাবি করছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ এবং তাঁর বন্ধু কর্ণেল (অব) শহিদের মধ্যকার ফাঁস হওয়া টেলিকথোপকথনে সেনাপ্রধান পরিস্কার করেই বলেছেন যে, বাংলাদেশের সকল গুম, খুনের হোতা শেখ হাসিনার আত্মীয় ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারেক সিদ্দিকী এবং জিয়াউল আহসান। কথোপকথনে এটাও প্রতীয়মান হয়েছে যে, এই সকল মানবতা বিরোধী অপরাধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পুর্ণ সায় রয়েছে অথবা তাঁর নির্দেশেই এ গুলো ঘটছে।
সুতরাং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে স্পষ্ট যে,সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেই গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের প্রতি নূতন হুমকি দেয়া হয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন