রাজধানীর শাহজাহানপুর, খিলগাঁও, গোড়ান ও মতিঝিলের একাংশের অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রক ছিলেন যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। ওই এলাকার ফুটপাত, মাছবাজার, পরিবহন, বিভিন্ন ঠিকাদারি কাজের টেন্ডার, কেবল ও ইন্টারনেট ব্যবসা, বাস কাউন্টারসহ পরিবহনে চাঁদার টাকা আসত খালেদের কাছে। ক্যাসিনোকাণ্ডে গ্রেপ্তার হয়ে তিনি এখন কারাগারে। কিন্তু খালেদের অপরাধজগৎ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ১০ সন্ত্রাসী। বিদেশে বসে সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণ করছেন জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিক। সমন্বয় করছেন আলী রেজা রানা।
এসব এলাকার বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি মাসে প্রায় তিন কোটি ৩১ লাখ টাকা অবৈধ চাঁদা আদায় করা হয়। বিপুল পরিমাণ ওই টাকা বিলি-বণ্টন করা হয় বিদেশে থাকা ফ্রিডম মানিকের নির্দেশে। সেটা করেন আলী রেজা রানা।
সূত্র জানায়, ওই টাকার ভাগ দেশের কারাগারে থাকা জিসান, বিদেশে থাকা মানিক, বিকাশ ও প্রকাশের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।
শাহজাহানপুরের একজন ঠিকাদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, আগে খালেদ ভূঁইয়া টাকা চেয়ে লোক পাঠাতেন। এখন মানিক বিদেশ থেকে ফোন করে টাকা চান, লোক পাঠান। জীবন বাঁচাতে আগেও টাকা দিয়েছি, এখনো দিচ্ছি। আগেও সন্ত্রাস ছিল, এখনো রয়েছে। শুধু হাতবদল হয়েছে।
বর্তমানে প্রতিবেশী একটি দেশে অবস্থান করা ফ্রিডম মানিকের বাসা শাহজাহানপুর। ১৯৮৯ সালে ধানমণ্ডির বত্রিশ নম্বরে সশস্ত্র হামলা হয়। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সে সময় ওই বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। হামলাকারীরা সবাই ছিল ফ্রিডম পার্টির ক্যাডার। ওই হামলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন মানিক ও খালেদ। তাঁদের নামে মামলাও হয়। আদালতে বাবার নাম ভুল দেখিয়ে মামলার অভিযোগপত্র থেকে খালেদের নাম বাদ দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর খালেদ যুবলীগে স্থান করে নেন। অন্যদিকে মানিক বিদেশে পাড়ি জমান। যুবলীগে যোগ দেওয়ার পর ওই এলাকার সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ চলে আসে খালেদের হাতে। ক্যাসিনোকাণ্ডে খালেদ আটক হলে বিদেশে বসেই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেন ফ্রিডম মানিক। তাঁর বিরুদ্ধে তিলপাপাড়ার পিচ্চি, শাহজাহানপুরের এজাজ, তালাশ ও তমাল, খিলগাঁওয়ের শরীফ ও ব্যবসায়ী মমতাজুর রহমান সোহেল, শান্তিবাগের মাসুদ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা কাউসার, ডিশ ব্যবসায়ী বিল্লা হত্যাসহ বেশ কয়েকটি হত্যা মামলা রয়েছে।
একটি সূত্র জানিয়েছে, মানিক, বিকাশ, প্রকাশ ও জিসানের নাম ব্যবহার করে সম্প্রতি ক্রীড়া ভবন, কৃষি ভবন, শিক্ষা ভবন ও গণপূর্তের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণে নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন রানা। একসময়ে খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার বন্ধু রানার বাসা রাজধানীর শান্তিনগরে। ২০১৩ সালে তিনি র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিনটি পিস্তল, ৮৬ রাউন্ড গুলি ও ৪০০ ইয়াবা ট্যাবলেটসহ।
জানা গেছে, ফ্রিডম মানিক ও রানা ছাড়া সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজিতে সক্রিয় আটজন হলেন মাসুম ওরফে কিলার মাসুম, সামিউল হক লিন্টু ওরফে কিলার লিন্টু, সৈয়দ রেজাউল করিম বাবু, ফ্রিডম সোহরাব, উদয় শংকর দে জিতু ওরফে কিলার জিতু, মানিকের ভাই স্বপন, যুবলীগের পদহীন নেতা রিফাত ও জুয়েল শাহরিয়ার। তাঁদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক চাঁদাবাজি ও হত্যা মামলা।
শাহজাহানপুরের একজন মাছ ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করে কালের কণ্ঠকে বলেন, তিনি বিভিন্ন স্থান থেকে মাছ কিনে এনে ওই বাজারে পাইকারি বিক্রি করেন। প্রতিদিন তাঁকে পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়।
একই এলাকার একজন খুচরা মাছ বিক্রেতা বলছেন, প্রতিদিন চাঁদা দিতে হয় ৩০০ টাকা। প্রতিদিন চাঁদা দিলেও অনেক ব্যবসায়ীই মুখ খুলতে নারাজ।
খিলগাঁও, শাহজাহানপুর, গোড়ান ও মতিঝিল এলাকায় সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, খিলগাঁও কাঁচাবাজারের ৮৪৫টি দোকান থেকে প্রতি মাসে চাঁদা আদায় করা হয় দুই লাখ টাকা। ওই টাকা আদায় করেন মানিকের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত কিলার মাসুম। এ ছাড়া মাদক কারবারের একটি অংশ আসে তাঁর কাছে। শাহজাহানপুর এলাকার মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করেন মানিকের ভাই স্বপন।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, ওই সব এলাকায় প্রতি মাসে মাদক কারবার থেকে গড়ে ২০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করেন স্বপন। তিনি মাদক বিক্রি করান কিছু শিশু ও নারীদের দিয়ে। এলাকাগুলোর একাংশে মাদকের কারবার দেখাশোনা করেন জুয়েল শাহরিয়ার। একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, এই কারবার থেকে মাসে প্রায় এক কোটি টাকা আসে। এলাকাগুলোর পরিবহন খাত থেকে মাসে কম করে হলেও ১৫ লাখ টাকা চাঁদা তোলেন সৈয়দ রেজাউল করিম বাবু ওরফে বাইলা বাবু। কাকারাইলের এসএ পরিবহন এলাকা থেকে শুরু করে রাজারবাগ, খিলগাঁও এলাকার বিভিন্ন ধরনের স্থানীয় পরিবহন থেকে চাঁদা তোলেন কিলার জিতু। এর পরিমাণ প্রায় ১০ লাখ টাকা।
খিলগাঁও, শাহজাহানপুর, মতিঝিল, রেল কলোনিসহ ওই এলাকায় প্রায় ১৫ হাজার বাড়ির কেবল ও ইন্টারনেট সংযোগ থেকে মাসে ৮০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। ওই চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন কিলার মাসুম। এর ক্ষুদ্র একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করেন বিএনপির হাসান। শাহজাহানপুর কাঁচাবাজার থেকে চাঁদা আদায় করেন রিফাত। বাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, গড়ে মাসে দুই লাখ টাকা তোলা হয় বাজার থেকে।
ওই সব এলাকায় চলাচলকারী লেগুনা থেকে চাঁদাবাজি দেখাশোনা করেন সামিউল হক লিন্টু। লেগুনা ও ব্যাটারিচালিত রিকশা থেকে দৈনিক মজুরিতে নিয়োগ করা একাধিক লোক চাঁদা তোলে। একাধিক চাঁদা আদায়কারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি মাসে প্রায় তিন লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়। ওই সব খাত বাদেও বিশেষ করে কিলার মাসুম, রানা ও স্বপনের মাধ্যমে প্রতি মাসে কম করে হলেও এক কোটি টাকার বেশি চাঁদাবাজি করা হয় বিভিন্ন নির্মাণপ্রতিষ্ঠান ও ঠিকাদারদের কাছ থেকে।
একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, গত ঈদুল আজহায় শাহজাহানপুর গরুর হাট ডাক নিয়েছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েক নেতা। তবে হাটের আয় থেকে ৮৭ লাখ টাকা দিতে হয়েছে ফ্রিডম মানিককে।
এলাকার সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে ওই এলাকার সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি জানি সন্ত্রাসের কাছে এলাকার মানুষ জিম্মি হয়ে রয়েছে। বিষয়টি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকেরা জানে না তা তো নয়। সন্ত্রাস-চাঁদাবাজ দমনে তারা যথাযথ ভূমিকা পালন করলে জিম্মিদশা থেকে সাধারণ মানুষের মুক্তি সম্ভব।’
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) জাহিদুল ইসলাম সোহাগ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ক্যাসিনোর সঙ্গে জড়িত শীর্ষ কারবারিসহ বেশির ভাগই ধরা পড়েছে। এলাকার সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজিও অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। তার পরও যদি সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি থেকে থাকে, অভিযোগ পেলেই আমরা ব্যবস্থা নেব। অভিযোগের ভিত্তিতে ইতিমধ্যে কিছু ব্যবস্থা আমরা নিয়েছিও।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন