বাংলাদেশের সদ্যপ্রয়াত সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেত্রী সাহারা খাতুন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিন বছর এবং তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম মহিলা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
আওয়ামী লীগ যখন ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসে তখন তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী হন।
আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার এক মাস পর ঢাকায় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী তৎকালীন বিডিআর-এ বিদ্রোহ হয়েছিল। তখন নতুন সরকারের নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন সাহারা খাতুন।
বিবিসি বাংলাকে ২০১২ সালে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদে থাকাকালীন তাঁর জন্য সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল বিডিআর বিদ্রোহ।
বাংলাদেশের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ২০১২ সালে বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় রদবদলের দুই দিন আগে এসেছিলেন বিবিসি বাংলার লন্ডন স্টুডিওতে।
একজন মহিলা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে খুবই কঠিন ও স্পর্শকাতর একটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল তাঁর হাতে, যেখানে দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়টি ছিল তাঁর অধীন, তাঁকে সামলাতে হচ্ছিল পুলিশ ও র্যাব।
তিনি বলেছিলেন তিনি নিজেকে ''রাজনীতিতে কখনও মহিলা হিসাবে দেখেননি, তিনি ছিলেন একজন রাজনীতিক।''
তিনি বলেন দায়িত্বটা ছিল কঠিন এবং যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের, কিন্তু তাঁর কথায় স্বচ্ছতার সাথেই এই দায়িত্ব পালনের চেষ্টা তিনি করেছিলেন।
সাহারা খাতুন বলেন আওয়ামী লীগ সরকারের দু মাস না হতেই বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে।
বিদ্রোহের ওই ঘটনায় ৫৭জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪জন মারা যান
সেসময় তিনি কোনরকম আতঙ্কে ছিলেন কিনা এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, "না। কারণ কাউকে না কাউকে যে কোন কাজের ভার নিতেই হবে। যখনই সকালবেলা যেই মুহূর্তে এখবর আমার কানে এসেছে, আমি সাথে সাথে মননীয় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে চলে যাই।
"এটা আতঙ্কিত বলুন, বিচলিত বলুন, আমরা তখন ভেবেছি, এরকম একটা ঘটনা, যদি এটা ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে দেশে একটা অন্যরকম পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে," বলেছিলেন সাহারা খাতুন।
যেহেতু বিডিআর ছিল তারই অধীন তিনি বলেন, "বিডিআর-এর আমর্স সারেন্ডার করার ব্যাপারটা দেখার জন্য প্রধানমন্ত্রী আমাকেই সেখানে পাঠিয়েছিলেন। আমি রাত বারোটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত ভেতরে ছিলাম। আমি প্রায় ১০-১২টা ফ্যামিলিকে উদ্ধার করে বাইরে নিয়ে এসেছিলাম।"
সাহারা খাতুন ২৬শে ফেব্রুয়ারি রাত আটটা দিকে পিলখানা থেকে বের হয়ে এসে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন সৈন্যরা সব অস্ত্র ও গোলাবারুদ পিলখানার দুটি ঘরে জমা রেখেছে এবং তাঁর হাতে ঘরগুলোর তালার চাবি দিয়েছেন।
ঢাকার তৎকালীন বিডিআর সদরদপ্তরে ২০০৯ সালের ২৫ এবং ২৬শে ফেব্রুয়ারি ওই বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের অভিযোগ ছিল যেহেতু তারা ক্ষমতায় আসার মাত্র ৪০দিনের মধ্যে এই ঘটনা ঘটে, তাই তাদের মনে হয় সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র থেকে এমন ঘটনা ঘটানো হয়।
বিচার বহির্ভূত হত্যার অভিযোগ
তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী থাকাকালীন বাংলাদেশে বিচার বহির্ভূত হত্যার অভিযোগ তিনি প্রত্যাখান করেন বিবিসি বাংলাকে দেয়া ওই সাক্ষাৎকারে।
বাংলাদেশের র্যাবের ভাবমূর্তি নিয়ে বহু বছর ধরে নানা বিতর্ক রয়েছে।
তিনি বাংলাদেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের আগে থেকেই বাংলাদেশে আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি দেশে বিদেশে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। ক্ষমতায় আসার আগে আওয়ামী লীগ এই সংস্কৃতি বন্ধের নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও তাঁর মন্ত্রীত্বকালেও একই ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে।
সাহারা খাতুন এ ব্যাপারে র্যাবের সমর্থনে কথা বলেছেন এমন অভিযোগ নিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি তা প্রত্যাখান করে বলেন, তিনি এটুকু আশ্বাস দিতে পারেন যে, তারা ক্ষমতায় আসার পর "বিচার বহির্ভূত হত্যা হয়েছে বলে তিনি স্বীকার করেন না।"
"জঙ্গীদের বিভিন্ন জায়গায় ধরা হচ্ছে, সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন জায়গায় ধরা হচ্ছে। মানুষ র্যাবকে এখন ধন্যবাদ দেয়।"
তিনি বলেন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভাল কি মন্দ তা বিচার করবে দেশের জনগণ। "সেই বিচারের ভার কিন্তু আমার ওপরে নয়।" সাহারা খাতুন বলেন তিনি এটুকু বলতে চান যে, "বিগত দশ বছরের মধ্যে ২০১১ সালে বাংলাদেশে সবচেয়ে ভাল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এটা আমার কথা নয়। এটা পত্রপত্রিকার কথা।"
সাগর-রুনি হত্যা ও ইলিয়াস আলী অর্ন্তধান
সাহারা খাতুন দায়িত্বে থাকাকালীন সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের তদন্ত সমাধান না হওয়া, বিরোধী রাজনীতিক ইলিয়াস আলীর অর্ন্তধান এসব নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
"রাতের বেলা গ্রিল কেটে যখন কোন মানুষকে হত্যা করা হয়, তখন অবশ্যই আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব, কারা দায়ী তদন্ত করে সেটা উদঘাটন করা। কিন্তু এই তদন্তকাজ চলাকালে মহামান্য হাইকোর্ট এর দায়িত্ব র্যাবের কাছে স্থানান্তরিত করেছেন। ফলে কাজটি নতুনভাবে শুরু করতে হয়েছে।
''হ্যাঁ, দেরি হচ্ছে। কিন্তু ইনশাল্লাহ- এই সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেভাবে কাজ করছে, বিগত সাড়ে তিন -পৌনে চার বছর ধরে- আমি যেভাবে তাদেরকে দেখছি, আমার সরকার যেভাবে দেখছে, আমি নিশ্চিত যে এই হত্যাকাণ্ড আমরা উদঘাটন অবশ্যই করবই করব।"
সাগর রুনি হত্যাকারীদের ৪৮ ঘন্টার মধ্যে ধরে বিচারের আওতায় আনা হবে মন্তব্য করে সমালোচনায় পড়েছিলেন সাহারা খাতুন
সেসময় তিনি বলেন যে এর কোন ক্লু বা সূত্র তারা পেয়েছেন কি না তা "বলার সময় আসেনি"। তদন্ত কাজ চলাকালীন যা জানা গেছে তা "আমাদের গোপন রাখতে হয়, সেগুলো মানুষের সামনে প্রকাশ করা ঠিক হবে না"।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারওয়ার আর মেহেরুন রুনি খুন হওয়ার পর সাহারা খাতুনের একটি মন্তব্য তখন ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করেছিল। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে গিয়ে সেসময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ৪৮ ঘন্টার মধ্যে হত্যাকারীদের আইনের আওতায় আনা হবে।
চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের আট বছর পরেও তদন্তের কোন রিপোর্ট আজও জমা দেয়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
২০১২ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারওয়ার ও মেহেরুন রুনি ঢাকায় পশ্চিম রাজাবাজার এলাকায় তাদের বাসায় নির্মমভাবে খুন হন। বেঁচে যান তাদের একমাত্র শিশু সন্তান মাহি সারওয়ার মেঘ।
বিবিসি বাংলাকে সাহারা খাতুন বলেন ইলিয়াস আলী কোথায়, কীভাবে গুম হলেন সেটা খুঁজে বের করা অবশ্যই সরকারের দায়িত্ব আর তাই তিনি গুম হবার পর "আমি ছুটে গিয়েছিলাম তার বাড়িতে, সকলকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে, দরজা বন্ধ করে, এককভাবে ইলিয়াস আলী সাহেবের স্ত্রী আমার সাথে আলাদাভাবে কথা বলেছিলেন।"
তিনি বলেন মিসেস আলী এমনকি নিজে যখন তার স্বামীকে খুঁজতে চেয়ে পূবাইলে নির্দিষ্ট একটি জায়গায় যেতে চান এবং সঙ্গে পুলিশ ও র্যাব নিয়ে যেতে চান, "তাকে সেই সহযোগিতা আমার সরকার দেয়", কিন্তু সাহারা খাতুন অভিযোগ করেন পরে বিরোধী দল এটা নিয়ে রাজনীতি করে।
তিনি বলেন, "তাকে খুঁজে আমাকে পেতেই হবে। আমি চেষ্টা করছি।"
'স্বচ্ছতার সাথে রাজনীতি করেছি'
সাহারা খাতুনের জন্ম ১৯৪৩ সনের ১লা মার্চ ঢাকায়। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন খুব ছোটবেলা থেকেই রাজনীতির সাথে তার যোগাযোগ।
তিনি বলেন অত্যন্ত ছোটবেলায় "প্যান্ট, ফ্রক পরা অবস্থা থেকে আমি রাজনীতি শুরু করেছি। সবসময় স্বচ্ছতার সাথে আমি রাজনীতি করেছি। অত্যন্ত স্বচ্ছতার সাথে আমার দায়িত্ব পালনের চেষ্টা এখন আমি চালিয়ে যাচ্ছি।"
সাহারা খাতুন ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, এবং বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ফাইন্যান্স কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি।
আইনের পেশায় থেকেই আওয়ামী লীগে প্রথম দিকে সক্রিয় ছিলেন সাহারা খাতুন। আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক হয়ে আন্দোলনের মাঠে তিনি ছিলেন, জেলও খেটেছেন। ২০০৪ সালের ১লা অগাস্ট গ্রেনেড হামলায়ও আহত হয়েছিলেন তিনি।
রাজনীতির পাশাপাশি মানুষের অধিকারের জন্য তিনি রাস্তায় আন্দোলন করেছেন। আইনজীবী হিসাবে মানুষের অধিকারের জন্য আদালতেও লড়াই করেছেন।
বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন: "সবসময় সত্যকে সত্য বলেই আমি প্রকাশ করি। আমার রাজনীতিও আমি সত্যকে দিয়েই শুরু করেছি।"
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন।
এরপর মন্ত্রীর দায়িত্ব আর না পেলেও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন সাহারা খাতুন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন