পাপিয়ার অপকর্ম প্রকাশ পাওয়ার পর এবার যুব মহিলা লীগেও শুদ্ধি অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলীয় পদ-পদবি ব্যবহার করে অপকর্মের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি সরকারপ্রধানের। গতকাল যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আকতার ও সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি তাদের কটাক্ষ করার পাশাপাশি সংগঠনে শুদ্ধি অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার কাছে অনেক রিপোর্ট আসছে, অনেকের নাম আছে। আমি কাউকে ছাড়ব না। রাত-দিন পরিশ্রম করে দেশের জন্য কাজ করছি। আর সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে অপকর্ম করবে? আমি কাউকে ছাড়ব না। এ ব্যাপারে প্রশাসনের সর্বস্তরে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ছাঁকুনি দিয়ে সংগঠনকে ঢেলে সাজাতে হবে।’ সূত্রমতে, গতকাল দুপুরে গণভবনে যান যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আকতার ও সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল। এ সময় তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে বলেন, ‘নেত্রী, আমরা সংগঠনের ভাবমূর্তিটা ধরে রাখতে পারলাম না। এখন আমাদের করণীয় কী? আপনি যে নির্দেশ দেবেন, আমরা সেটাই করব।’ এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কারা কী করছে সব তথ্য আমার কাছে আসছে। অনেকের নাম এসেছে। আমি কাউকে ছাড়ব না। ঢাকায় কোথায় কে কী করছে সব তথ্য আমার কাছে আছে। একজনও ছাড় পাবে না।’ এ সময় সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে সারা দেশের সংগঠনের নেত্রীদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে বলেন তিনি। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, ‘সারা দেশে খোঁজখবর নাও। ছাঁকুনি দিয়ে ছেঁকে নাও। সংগঠনের ইমেজ উদ্ধার করতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সত্যতা নিশ্চিত করে যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আকতার ও সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘গতকাল বিকালে আমরা দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করি। তাঁর কাছে বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কী সে পরামর্শ চাই। এ সময় প্রধানমন্ত্রী আমাদের সংগঠনের সারা দেশের নেত্রীদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে বলেছেন। একই সঙ্গে ঢাকায় কে কোথায় কী করছেন সব তথ্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আছে বলে তিনি জানিয়েছেন।’
এসএসসি পর্যন্ত পাঠক্রমে বিভাজনের দরকার নেই : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিজ্ঞান শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় নবম শ্রেণি থেকেই বিষয়ভিত্তিক বিভাজন (বিজ্ঞান-কলা-বাণিজ্য) তুলে দেওয়ার বিষয়ে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, ‘এটা না থাকাই ভালো। এসএসসির পর গিয়ে যদি বিভক্ত হয়, সেটাই ভালো।’ গতকাল সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীদের মাঝে ‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক-২০১৮’ বিতরণকালে তিনি এসব কথা বলেন। খবর বাসস। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের সর্বোচ্চ নম্বর/সিজিপিএ প্রাপ্তদের হাতে ‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক-২০১৮’ তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি অনুষ্ঠানে দেশের ৩৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭২ জন মেধাবী শিক্ষার্থীর মাঝে স্বর্ণপদক বিতরণ করেন। এদের মধ্যে ৮৪ জন ছাত্র এবং ছাত্রী রয়েছে ৮৮ জন। ২০১৭ সালে ১৬৩ জন শিক্ষার্থী প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক লাভ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রসঙ্গ টেনে এজন্য শিক্ষার্থীদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘এখন সব সাবজেক্টই বিজ্ঞানভিত্তিক। সেটা ধীরে ধীরে চলেই এসেছে। বিজ্ঞানের বাইরে কিছু নেই।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের (দেশে) ক্লাস নাইন থেকে কে কোন সাবজেক্টে যাবে সেটা ভাগ করে দেওয়া হয়। আমার মনে হয়, এই ভাগটা থাকার কোনো দরকারই নাই। কারণ, এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত সব সাবজেক্টই তারা পড়তে পারে।’ তিনি বলেন, বিশ্বের অনেক দেশেই এমনটা নেই। কারণ, বিজ্ঞান না পড়ার ফলে অনেক বিষয়েই শিক্ষার্থীরা পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। আর আমাদের দেশে ১৯৬৩ সালে আইয়ুব খান (পাকিস্তান আমলে) সরকারের সময় এটা করা হয় বলেও তিনি উল্লেখ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের জনসংখ্যাকে আমরা যদি কারিগরি, বিজ্ঞানভিত্তিক এবং প্রযুক্তি শিক্ষার মাধ্যমে সেইভাবে দক্ষ করে গড়তে পারি তাহলে আমাদের কোনো সমস্যাতো কোনোদিন হবেই না বরং আমরা অন্য দেশকে সাহায্য করতে পারব। তাঁর সরকার দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং সে লক্ষ্যে একটি সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সেক্ষেত্রে আমরা কাউকেই অবহেলা করতে চাই না। যে কারণে, আমাদের মাদ্রাসা শিক্ষার সঙ্গে অনার্স কোর্স চালু এবং প্রযুক্তি শিক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের কওমি মাদ্রাসাকেও আমরা স্বীকৃতি দিয়েছি এবং দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স সমমান দিয়েছি। কারণ, তাদেরও আমরা সমন্বিত শিক্ষার মধ্যে নিয়ে আসতে চাই। একই ডিসিপ্লিনে নিয়ে আসতে চাই।’ একটি সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলায় তাঁর সরকারের প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একই সঙ্গে প্রত্যেক উপজেলায় কারিগরি স্কুল, কলেজ এবং প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। তিনি বলেন, যার যেভাবে শিক্ষা গ্রহণ বা কর্মক্ষেত্রে কাজ করার দক্ষতা রয়েছে সে সেভাবেই শিক্ষালাভ করতে পারবে। সে সুযোগটা সৃষ্টি করে দেওয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা চাই, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে যেন আমাদের মঞ্জুরি কমিশন খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী নিয়োগসংক্রান্ত একটা অভিন্ন নীতিমালা করা।’ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে আরও শক্তিশালী করা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় করেছি সেগুলোর যেন ভালোভাবে নজরদারি করতে পারে, সেদিকে লক্ষ্য রেখে এটাকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা আমরা নিচ্ছি এবং নেব।’ তিনি বলেন, ‘চিন্তা করে দেখেন- শিক্ষার মানোন্নত করার জন্য এবং শিক্ষিত জাতি গড়ে তোলার জন্য আমাদের আর কী কী প্রয়োজন। যা প্রয়োজন, আমরা তাই করব এবং সেটাই আমাদের নীতি।’ সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে প্রযুক্তি শিক্ষা, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম তৈরি, অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাসহ ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সারা দেশেই আমরা ইন্টারনেট সার্ভিস দিচ্ছি, ব্রডব্যান্ড লাইন দিচ্ছি, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করেছি, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ এর কাজ চলছে।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভবিষ্যতে হয়তো আরও নতুন নতুন পদ্ধতি আসবে। কিন্তু যখনই যেটা আসবে তার জন্য আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা সবসময় যেন প্রস্তুত থাকতে পারে সেভাবেই তাদেরকে আমরা গড়ে তুলতে চাই।’ সারা দেশে বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার মেরিন একাডেমির সঙ্গে মেরিন বিশ্ববিদ্যালয় করেছে, ডিজিটাল, টেক্সটাইল এবং ফ্যাশন ডিজাইনিং বিশ্ববিদ্যালয়ও করেছে। একই সঙ্গে লালমনিরহাটে একটি অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়ও করছে। তিনি বলেন, তাঁর সরকার প্রতিটি জেলাকে ভাগ করে, কোথায় কোনটা প্রতিষ্ঠা করা হবে, তা ঠিক করে দিচ্ছে, যাতে কেবল রাজধানীকেন্দ্রিক উন্নয়ন না হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তিনটা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আমরা করেছি এবং প্রত্যেকটা বিভাগে একটি করে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা হবে। যেখানে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সেখানে কয়েকটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় করেছি এবং বিজ্ঞান শিক্ষাকে শিক্ষার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় করার জন্য ‘৯৬ সালেই ১২টি বিজ্ঞান ও প্রযুুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আইন পাস করে যাই। সরকার গবেষণার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘গবেষণা ছাড়া কখনো উৎকর্ষতা লাভ করা যায় না। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের চলতে হলে গবেষণার বিকল্প নেই। অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন। ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব ফিশারিজ টেকনোলজির শিক্ষার্থী মো. মোবারক হোসেন এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজের শারমিন সুলতানা অনুষ্ঠানে পুরস্কার বিজয়ীদের পক্ষে অনুভূতি ব্যক্ত করে বক্তৃতা করেন।
শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস এবং ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন