আর এক সপ্তাহ পর ঢাকার দুই সিটিতে নির্বাচন। কিন্তু এখনো আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা কাউন্সিলর নির্বাচনের প্রার্থিতা নিয়ে গৃহবিবাদে লিপ্ত। এখনো ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির অনেক ওয়ার্ডেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর জন্য বিষফোঁড়া হয়ে আছেন দলেরই অনেক প্রার্থী, যারা কেন্দ্র থেকে সমর্থন না পেলেও মাঠ ছাড়ছেন না। এমন অনেক ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’কে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি একাধিকবার নির্দেশ দিয়েছে, দলীয় প্রার্থীদের সমর্থন জানিয়ে মাঠ ছেড়ে দিতে; দফায় দফায় তাদের সঙ্গে বৈঠকও করেছে, করছে।
কিন্তু এর পরও অনেককেই মাঠ থেকে সরাতে পারেনি। শুধু তাই নয়, পুনর্বার দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থীদের নামও প্রকাশ করেছে কমিটি, যেন কারও কোনো দ্বিধা না থাকে। কিন্তু বিদ্রোহীরা তাতে কান দেননি। উপরন্তু নিজেদেরই দলের মনোনীত প্রার্থী জানিয়ে স্থানীয় ভোটারদের মধ্যে প্রচার চালাচ্ছেন। দল মনোনীত প্রার্থীরা নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কাছে এসব বিষয়ে বারবার অভিযোগ করছেন। এর প্রেক্ষিতে কমিটি যে নির্দেশ দিচ্ছে তাও মানছেন না বিদ্রোহীরা। আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের জয়ের পথে এসব ঘরের প্রার্থীরাই বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবেন।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দুজন নেতার মতে, স্থানীয় সাংসদ ও দলের কেন্দ্রীয় কিছু নেতার প্রশ্রয় পাচ্ছেন বলেই বিদ্রোহীরা মাঠ ছাড়ছেন না। আরও একটি বড় কারণ হলো-অতীতের অনেক স্থানীয় নির্বাচনেই দেখা গেছে, দলের সিদ্ধান্ত না মেনে যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের মাঠে থেকে লড়াই চালিয়ে গেছেন, ভোটের আগে তাদের কঠোর শাস্তির হুশিয়ারি দেওয়া হলেও ভোটের পর তা কার্যকর করা হয়নি; বরং ক্ষেত্রবিশেষে পুরস্কৃত হয়েছেন বিদ্রোহী অনেক প্রার্থী। এ কারণে এবারও দলের নির্দেশ, হুশিয়ারি ইত্যাদি উপেক্ষা করেই মাঠে রয়ে গেছেন বিদ্রোহীরা।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, নিজ দলেরই বিদ্রোহী প্রার্থীর কারণে অনেক ওয়ার্ডে বিএনপির প্রার্থীরা সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন। তারা জানান, দলীয় প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে এসব ওয়ার্ড চিহ্নিত করে বিদ্রোহীদের সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠক করছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। দুএকদিনের মধ্যে অনেক বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচনী মাঠ থেকে সরে দাঁড়াবেন, এমন প্রত্যাশাও করছেন তারা।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও ঢাকা দক্ষিণ নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু বলেন, আমার বিশ্বাস, শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহীরা নির্বাচনী মাঠে থাকবেন না। যদি কেউ থাকেনও, তার বা তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে ২০১৫ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মো. হাসান পিল্লু কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। তিনি স্থানীয় (ঢাকা-৭) আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ভাগ্নে। হাজী সেলিমও এক সময় এ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন। এবারের নির্বাচনে পিল্লুকেই সমর্থন দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
কিন্তু হাজী সেলিম নিজেই ভাগ্নে পিল্লুর সঙ্গে নেই। তিনি চাইছেন পিতার উত্তরসূরি হিসেবে পুত্র এ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হোক। তার ছেলে ইরফান সেলিম এ ওয়ার্ড থেকে এবার নির্বাচন করছেন। আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের স্থানীয় যত কমিটি আছে, সে সব কমিটিতে হাজী সেলিমের বলয়ের একক আধিপত্য। ফলে আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েও কাউন্সিলর প্রার্থী হাসান পিল্লু দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে মাঠে নামতে পারছেন না। এমপির বিরুদ্ধে গিয়ে কেন্দ্র সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে নামার ঝুঁকি নিতে চাইছেন না স্থানীয় নেতাকর্মীরা।
পিল্লু বলেন, আমার হয়ে নির্বাচনী প্রচার চালানোর কারণে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের এলাকা-ছাড়া করা হচ্ছে। অনেককে মারধর করে তাদের বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব দেখে মাঠে নামার সাহস পাচ্ছেন না কেউই। দলের হাইকমান্ড সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে প্রত্যাশা তার।
ডিএসসিসির ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আর বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে প্রায় প্রতিদিনই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। গত শুক্রবারও দুগ্রুপের সংঘর্ষে কয়েকজন আহত হন। তফসিল ঘোষণার পর থেকেই এমন দশা, তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে বেধে যাচ্ছে সংঘর্ষ। জানা যায়, কামরাঙ্গীরচর থানাধীন এ ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থন দিয়েছে মোহাম্মদ হোসেনকে। গত নির্বাচনে কাউন্সিলর নির্বাচিত এ প্রার্থীর সঙ্গে এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন আওয়ামী লীগেরই আরও তিন প্রার্থী।
শুধু তাই নয়, ওই তিন প্রার্থী একাট্টা হয়েছেন মোহাম্মদ হোসেনের বিপক্ষে। এ ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা হলেন- থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইদুর রহমান রতন, দলটির ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড সভাপতি আমিনুল ইসলাম এবং একই দলের নেত্রী মাহমুদা ফেরদৌসী।
স্থানীয় সাংসদ অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের বিশ্বস্ত হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ হোসেন। পুরো কামরাঙ্গীরচর থানার সকল উন্নয়ন কাজের পাশাপাশি সংসদীয় এলাকাটিতে এমপির বলয়ের রাজনীতির অন্যতম ক্রীড়নক তিনি। এ প্রসঙ্গে কাউন্সিলর প্রার্থী সাইদুর রহমান রতন আমাদের সময়কে বলেন, বছরের পর বছর ধরে আমরা নির্যাতিত। দল ক্ষমতায় থাকলেও আমরা আছি বিরোধীদলের নেতাদের মতো চাপে। মামলা-হামলায় ঘরছাড়া এখানকার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা।
স্থানীয় কাউন্সিলর হোসেন এ এলাকায় রামরাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছেন। তার নির্যাতন থেকে রেহাই পেতে দলের নির্যাতিত নেতাকর্মীদের অনুরোধে আমি প্রার্থী হয়েছি। রতনের প্রচারকাজে নানাভাবে বাধা দেওয়া হচ্ছে এবং দলীয় নেতাকর্মীদের মারধর করা হচ্ছে। এমনকি নারী কর্মীরাও রেহাই পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেন তিনি।
অন্যদিকে এসব অভিযোগ খ-ন করে মোহাম্মদ হোসেন বলেন, আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। আমি সাধারণ মানুষের ভালোবাসায় রাজনীতি করি। কোনোরকম অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত নই। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বারবার বলার পরও এ ওয়ার্ডে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরা মাঠ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন না; দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করছেন। এর পরও আমি জয়ী হবো ইনশাল্লাহ, দৃঢ়তার সঙ্গে আশাবাদ ব্যক্ত করেন হোসেন।
ডিএসসিসির ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক ড. ওমর বিন আজিজ তামিম। এ ওয়ার্ডে ক্ষমতাসীন দলটির বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মাঠে আছেন ছাত্রলীগের বৃহত্তর লালবাগ থানার সাবেক সভাপতি সাগর আহম্মেদ শাহিন। তিনি স্থানীয় এমপি হাজী মোহাম্মদ সেলিমের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। এখানেও আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীর বিরোধের কারণে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে।
ডিএসসিসির ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েছেন গত নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে জয়লাভ করা হাসিবুর রহমান মানিক। এ ওয়ার্ডে দলটির বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে এখনো মাঠে সক্রিয় ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি হাসিব উদ্দিন রসি। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের তথ্যমতে, স্থানীয় এমপি হাজী সেলিম বিদ্রোহী প্রার্থী রসির পক্ষে আছেন। জানা গেছে, ইতিমধ্যেই রসির নির্বাচনী প্রচারে দেখা গেছে হাজী সেলিমের ছেলে সোলায়মান সেলিম, লালবাগ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান জামালকে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েছেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ। তবে এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন বর্তমান কাউন্সিলর ও ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান নাঈম। এ ওয়ার্ডেও বিদ্রোহী প্রার্থী প্রচারে বাধা দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন দল সমর্থিত প্রার্থী। এ বিষয়ে আনিসুর রহমান নাঈম বলেন, আমি নির্বাচনী মাঠে রয়েছি বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নয়। আমার সঙ্গে দলের সবাই আছে।
ডিএনসিসির ৬ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী সালাহউদ্দিন রবিন। এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে সক্রিয় আছেন ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তাইজুল ইসলাম চৌধুরী বাপ্পী ওরফে বাপ্পী চৌধুরী। এখানেও বিদ্রোহী প্রার্থী প্রচারে বাধা দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে দল সমর্থিত প্রার্থী সালাহউদ্দিন রবিনের।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন