১৯৮৮ সালে লালদীঘি ময়দানে সেই জনসভায় শেখ হাসিনা (ছবি: ফোকাস বাংলা)
ওই দিন যখন শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হচ্ছিলো, তখন আমিসহ ১০-১২ আইনজীবী উনাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাই। তখন নেত্রী পুলিশকে উদ্দেশ করে মাইকে বলেছিলেন, আমি বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা বলছি, আপনারা গুলি চালাবেন না। নেত্রীর এই নির্দেশ উপেক্ষা করে ওইদিন পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। তাদের গুলিতে ২৪ জন নিহত হয়েছেন। আমরা তাদের কারও লাশও পাইনি। মির্জা রকিবুল হুদা, জে সি মণ্ডলসহ অন্যরা ওই দিন হিন্দু, মুসলিম নির্বিশেষে নিহত ওই ২৪ জনের লাশ পুড়িয়ে দিয়েছিল।’
৩২ বছর আগে চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে আওয়ামী লীগের জনসভায় হামলার ঘটনা মনে করে এসব কথা বলেন জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি সিনিয়র আইনজীবী ইব্রাহিম হোসেন বাবুল। এই মামলার রায়ে আসামিদের মৃত্যুদণ্ডের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘এ রায়ের মাধ্যমে আমাদের দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে। আমরা প্রতিবছর ২৪ জানুয়ারি এই শহীদ মিনারে এসে কর্মসূচি পালন করতাম আর বিচারের দাবি জানাতাম। এই রায়ের মাধ্যমে আমাদের সেই প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে। আমরা ওই দিন স্বজন হারানো আমাদের বন্ধুদের কোনও সান্ত্বনা দিতে পারতাম না। তিনদিন পর ২৪ জানুয়ারি এবার হয়তো কিছুটা সান্ত্বনা তারা পাবেন।’
লালদীঘি ময়দানে হামলায় আহতদের সঙ্গে শেখ হাসিনা (ছবি: বাসস)
পাঁচ আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন বাদী পক্ষের আইনজীবীরাও। আইনজীবী এরশাদ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ রায়ের মধ্য দিয়ে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে। রায়ে আমরা অত্যন্ত খুশি। আমরা চাই উচ্চ আদালতও যেন রায়টি বহাল রাখেন এবং খুব দ্রুত রায় কার্যকর করেন।’
অ্যাডভোকেট এরশাদ হোসেন এই মামলার বাদী আইনজীবী মো. শহীদুল হুদার ছেলে। এরশাদের পতনের পর ১৯৯২ সালের ৫ মার্চ শহীদুল হুদা বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। ওই মামলার চার্জশিটে আট পুলিশ সদস্যকে আসামি করা হয়।
এরশাদ হোসেন বলেন, ‘আমার বাবা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই সময় মামলা দায়ের করেছেন বলেই আজ রায় পেয়েছি। যারা সেদিন জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে চেয়েছিল, এ রায়ের মাধ্যমে তাদের আজ ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছে।’
১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি বন্দরনগরীর লালদীঘি মাঠে আওয়ামী লীগের জনসভার দিন ছিল। ওই দিন বেলা ১টার দিকে শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রাক আদালত ভবনের দিকে এগোলে নির্বিচার গুলি ছোড়া শুরু হয়। পুলিশের গুলিতে ওইদিন ২৪ জন নিহত হন। এ সময় আইনজীবীরা আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে ঘিরে মানববেষ্টনী তৈরি করে তাকে নিরাপদে আইনজীবী সমিতি ভবনে নিয়ে যান। ওই ঘটনায় নিহত কারও লাশ পরিবারকে নিতে দেয়নি স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সরকার। সবাইকে বলুয়ার দীঘি শ্মশানে পুড়িয়ে ফেলা হয়। ঘটনার চার বছর পর ১৯৯২ সালের ৫ মার্চ এ ঘটনায় মামলা দায়ের করেন আইনজীবী মো. শহীদুল হুদা। ১৯৯৭ সালের ১২ জানুয়ারি প্রথম দফায় অভিযোগপত্র দাখিলের পর অধিকতর তদন্ত শেষে ১৯৯৮ সালের ৩ নভেম্বর দ্বিতীয় দফায় অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা। অভিযোগপত্রে আট পুলিশ সদস্যকে আসামি করা হয়। ওই মামলায় ৫৩ জন আসামির সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে আজ আদালত রায় দেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি (পিপি) অ্যাডভোকেট মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আসামিদের বিরুদ্ধে পৃথক চারটি ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়েছিল। এসব ধারায় বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে আসামিদের। হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকায় ৩০২ ধারায় পাঁচ আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। অন্যদিকে ৩২৬ ধারায় প্রত্যেক আসামিকে ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আদালতে উপস্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণে প্রমাণিত হয়েছে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদার নির্দেশে জে সি মণ্ডল তার অধীন পুলিশ সদস্যদের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা ওই ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন।’
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ইফতেখার সাইমুল ইসলাম বলেন, ‘রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। এ ধরনের একটি রায়ের জন্য আমরা দীর্ঘদিন অপেক্ষায় ছিলাম। অবশেষে আমরা কাঙ্ক্ষিত রায় পেয়েছি। আমরা চাই রায় দ্রুত বাস্তবায়ন হোক। যারা ওই দিন দুঃসাহস দেখিয়েছে, নির্বিচারে সাধারণ মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছে, তারা ফাঁসিতে ঝুলুক।’
আপিল করবে আসামি পক্ষ
রায়ে অসন্তুষ্টি জানিয়ে আসামি পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ আহসান খান জানিয়েছেন, এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন তারা। তিনি বলেন, ‘রায়ের আগেই আমরা এই আদালতের ওপর অনাস্থা জানিয়েছিলাম। গতকাল (১৯ জানুয়ারি) আমরা আদালতের ওপর অনাস্থা দিয়েছি। আদালত পক্ষপাতদুষ্ট রায় দিয়েছেন। আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করবো।’ ২২ জানুয়ারি উচ্চ আদালতে আপিল করবেন বলে তিনি জানান।
তিনি আরও বলেন, ‘ঘটনার সময় আমার চার মক্কেল ঘটনাস্থলে ছিলেন না। ঘটনার পর ১৯৮৮ সালে বিচারপতি আমিনুর রহমান খানের নেতৃত্বে এই ঘটনার জুডিশিয়াল তদন্ত হয়েছিল। ওই তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, আমার মক্কেল ঘটনাস্থলে ছিলেন না। আদালতের নথিপত্র থেকে ওই তদন্ত প্রতিবেদন মিসিং হয়ে গেছে। এটি উদ্ধার করার জন্য আমরা আদালতে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু আদালত আমাদের আবেদন গ্রহণ করেননি।’
আদালত তড়িঘড়ি রায় ঘোষণা করেছেন জানিয়ে আসামি পক্ষের এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘যুক্তি উপস্থাপনের জন্য আদালত আমাদের যথেষ্ট সময় দেননি। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে গতকাল (১৯ জানুয়ারি) রাষ্ট্রপক্ষ যুক্তি উপস্থাপন করেন। এরপরই আজ আসামি পক্ষের যুক্তি উপস্থাপনের সময় নির্ধারণ করে দেন আদালত। এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার যুক্তি উপস্থাপনের মাত্র একদিন সময় মোটেও যথেষ্ট নয়।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন