মুন্সিগঞ্জে দলীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে গত ১০ বছরে চাঁদাবাজি, জমি দখল, টেন্ডারবাজি, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা করে বিপুল অর্থ ও সম্পদের পাহাড় গড়ার অভিযোগ তুলে কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) বিকেলে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে মুন্সিগঞ্জ এলাকাবাসীর পক্ষে এ লিখিত অভিযোগ করেন জয়নাল আবেদিন নামে এক ব্যক্তি।
অভিযুক্তরা হলেন- মুন্সিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি’র দ্বিতীয় স্ত্রী সোহানা তাহমিনা, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ লুৎফর রহমান, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আনিস উজ্জামান আনিস, মিরকাদিম পৌরসভার মেয়র শহিদুল ইসলাম শাহিন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফসার উদ্দিন ভুইয়া আফসু, গোলাম মোস্তফা ও বাচ্চু শেখ।
অভিযোগে তিনি তথ্য যাচাই-বাছাই পূর্বক যেন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুদক চেয়ারম্যানকে অনুরোধ জানান।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনিস উজ্জামান আনিস বিপুল পরিমাণ সম্পদ ও নগদ টাকার মালিক। যার সবই অবৈধ। মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজার, অবৈধভাবে ইজারা দিয়ে গত ১০ বছরে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। শহরের কাচারী এলাকায় মুন্সিগঞ্জ কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সামনে সরকারি মালিকানা প্রায় ৩০ শতাংশ জমি দখল করে ৫ তলা মার্কেট ভবন নির্মাণ করেছেন। সেখান থেকেও তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় ৪০ কোটি টাকা। মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার বজ্রযোগিনী ইউনিয়নে হিন্দু পরিবারের ৭০ শতাংশ জায়গা জোর করে দখল করেছেন। মুন্সিগঞ্জের বালুমহল থেকে প্রতিমাসে চাঁদা নেন প্রায় ২ কোটি টাকা। এসব টাকা লেনদেনের জন্য বিভিন্ন বিদেশি ব্যাংকে একাউন্ট রয়েছে তার। আনিস কানাডায় করেছেন বিলাসবহুল বাড়ি।
আনিসের ছোট ছেলে জালালুদ্দিন রুমি রাজন বাংলাদেশের শীর্ষ অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীদের মধ্যে একজন। অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা করে গত ১০ বছরে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন রাজন। কক্সবাজারের ইয়াবা ব্যবসায়ীদের হাত করে মুন্সিগঞ্জে ইয়াবার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন বলেও উল্লেখ করা হয়। মের্সাস রাজন ট্রেডার্স নামে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানে খুলে টেন্ডার বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন আনিসপুত্র।
আনিসের ছোট ছেলে আক্তারুজ্জামান রাজিব। জেলা যুবলীগের বহিস্কৃত সভাপতি। মসজিদের নির্মাণ কাজে চাঁদাদাবি ও ভূমি দখলের অভিযোগে যুবলীগ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে । আক্তারুজ্জামান রাজিব গত কয়েক বছরে চাঁদাবাজি, জমি দখল, টেন্ডারবাজি, করে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তার বিদেশি ব্যাংক একাউন্ট রয়েছে। সে বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার করে দিয়েছেন।
মিরকাদিম পৌরসভার মেয়র হয়ে শাহিন বিভিন্ন অপকর্ম করে বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন। এরমধ্যে ঢাকায় ধানমন্ডিতে তার আলিশান ফ্লাট যার মূল্য প্রায় ২ কোটি টাকা, নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে করেছেন ৪টি বাড়ি। মুন্সিগঞ্জের মিরকাদিমের টেঙ্গর এলাকায় স্ত্রীর নামে কিনছেন ৪০ শতাংশ জমি, রিকাবীবাজারে তার রয়েছে ২টি ৪তলা বাড়ি। জমি ও বাড়ি মিলিয়ে সেখানে খরচ করেছেন প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। মিরকাদিমের গোয়ালঘুন্নী এলাকায় সরকারের খালের জমিতে ৫ম তলা বহুতল ভবন নির্মাণ করে ২০ কোটি টাকায় অন্য একজনের কাছে বিক্রি করে দেন মেয়র শহিদুল ইসলাম শাহিন। নয়নের খাল, রিকাবীবাজার খাল, ফেচন্নীর খাল ও গোপপাড়া খাল দখল করে ১৫-২০ লাখ টাকা শতাংশ করে স্থানীয়দের কাছে বিক্রি করে মেয়র শাহিন এখন কয়েকশ কোটি টাকার মালিক। এছাড়াও মেয়র শহিদুল ইসলাম শাহিনের পালের বাড়িতে ৫০ শতাংশ, ওয়াপদায় ৩০ শতাংশ। নুরপুর কালিন্ধিবাড়ি মৃধাবাড়ি এলাকায় ২০ শতকের ওপর ৪ তলা বাড়ি। রিকাবীবাজার এলাকায় ৬ শতাংশ জায়গায় ৩ তলা বাড়ি। নুরপুর গোপপাড়ায় ২০ শতাংশের ওপর ৩ তলা বাড়ি। গোপালনগর গার্লস্কুল এলাকার রায়বাড়িতে ৩০ শতাংশ জমি। ঢাকার পরিবাগে ফ্ল্যাট। নয়নের খাল দখল করে দোকান তুলেছেন শাহিন। সেখান থেকে প্রতি মাসে ২০ লাখ টাকা সরকারের চোখ ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে উপার্জন করেন। সর্বশেষ মিরকাদিমের পূর্বপাড়া জামে মসজিদের ৩০ লাখ টাকা নিজের অ্যাকাউন্টে এনে আত্মসাৎ করে শহিদুল ইসলাম শাহিন।
মুন্সিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী সোহানা তাহমিনা অবৈধ ক্ষমতার জোরে মুন্সিগঞ্জ শহরের হাটলক্ষীগঞ্জ এলাকায় জেলা পরিষদের ১০০ শতাংশ জমি দখল করে দোকান ঘর নির্মান করে ভাড়া দিয়ে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। মুন্সিগঞ্জ শহরের পুলিশ লাইন্স এলাকায় সরকারি জমিতে ২০টি দোকান বসিয়েছেন। সেখান থেকে প্রতিমাসে আয় করছেন কয়েক লাখ টাকা। উত্তর কোটগাঁওতে রয়েছে ১৫০ শতক জমি, ঢাকায় রয়েছে ৩টি ভবন। সদর উপজেলার বাংলাবাজার ইউনিয়নের কাবিয়ারচরে রয়েছে সাড়ে ৯ বিঘা জমি। সিংগাপুর ও মালয়েশিয়ার তার দুইটি বাড়ি রয়েছে। গত কয়েক বছরে তার স্বামীর অবৈধ উপার্জনের সব টাকা তিনি তার পুত্রদয়ের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেছেন।
মুন্সিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ লুৎফর রহমান ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে পদ-বাণিজ্য ও জমি দখল করে বিক্রির মাধ্যমে গত কয়েক বছরে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার বজ্রযোগিনীতে ১৫০ শতাংশ তার বাগান বাড়ি রয়েছে। ঢাকার গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ি, ফার্মগেট এলাকায় লুৎফর রহমানের কয়েক কোটি টাকা মূল্যের ৩টি বাড়ি রয়েছে।
মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফসার উদ্দিন ভুইয়া আফসু গত ১০ বছরে নানা অনিয়ম, লুটপাট, দুর্ণীতি ও সেচ্ছাচারিতা করে শত শত কোটি টাকা অবৈধ উপার্জন করেছেন। দেশী -বিদেশি ব্যাংকে তার ও তার স্ত্রী সন্তানের নামে কয়েক’শ কোটি টাকা রয়েছে। ঢাকার শনিরআখড়া এলাকায় তার ৩০ শতাংশ জমির উপর ৫ তলা ভবন রয়েছে। যার আনুমানিক মুল্য ৫০ কোটি টাকা। মুন্সিগঞ্জের চরকেওয়ার ইউনিয়নের উত্তর চরমসুরা গ্রামে আফসুর ২০০ শতাংশ এরও বেশি জমি রয়েছে। বালুমহল থেকে প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকা, মাসে কমপক্ষে কোটি টাকা চাঁদা নেন আফসার উদ্দিন ভুইয়া আফসু। ৬৫ লাখ টাকার গাড়িতে চড়েন আফসু। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৫ লাখ টাকা থেকে শুরু করে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত দলের মনোনয়ন বিক্রি করে অবৈধভাবে উপার্জন করেছেন। মালিবাগে ৩ কোটি টাকা দিয়ে আফসু ফ্ল্যাট কিনেছেন। ঢাকার উত্তরায় আফসার উদ্দিন ভুইয়া আফসুর মেয়ের নামে রয়েছে বিলাসবহুল দুইটি ফ্ল্যাট। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ৬০ কোটি টাকা। মুন্সিগঞ্জের চরকেওয়ার ইউনিয়নে আফসুর ২০০ শতাংশ এরও বেশি জমি রয়েছে। মুন্সিগঞ্জ শহরের মানিকপুর এলাকায় বিলাসবহুল দুইট বাড়ি রয়েছে।
মুন্সিগঞ্জ পঞ্চসার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা পঞ্চসার এলাকায় অবৈধ কারেন্ট জাল ব্যবসা পরিচালক সমিতি খুলে প্রতিমাসে কোট কোটি টাকা চাঁদা তুলে নিচ্ছেন। মোস্তফা ও তার স্ত্রী ডালিয়া বেগমের নামে দেশ-বিদেশে বিভিন্ন ব্যাংকে কয়েক’শ কোটি টাকা রয়েছে। মালয়েশিয়াতে দুইটি বাড়ি কিনেছেন। মুন্সিগঞ্জের মুক্তাপুর, বাগানবাড়ি, গোসাইবাগ এলাকায় তার ৫০০ শতাংশ জমি রয়েছে। ঢাকার উত্তরাতে তার স্ত্রীর নামে একাধিক ফ্লাট রয়েছে। বিএনপির আমলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ফেরি আটকে দিয়েছিল। মুন্সিগঞ্জে ঢুকতে দেয়নি। বহু হত্যা মামলার আসামি এই মোস্তফা।
মুন্সিগঞ্জ রামপাল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাচ্চু শেখ ওরফে ‘বাচ্চু ডাকাত’। টেন্ডার, দখলদারী ও ভূমি দস্যুতা করে প্রায় ২শ কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। মুন্সিগঞ্জের রামপাল ইউনিয়নের কাজীকাবরা, ধলাগাঁও, সিপাহীপাড়া ও বল্লাবাড়ী এলাকায় তার ৫০০ শতাংশ জমি রয়েছে। যার মূল্য প্রায় ৩০ কোটি টাকা। রামপালের বল্লালবাড়ি ৬০শতাংশ জমি যার মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। রামপালের সিপাহীপাড়ায় জেলা পরিষদের ৪৫ শতাংশ জায়গায় দোকানঘর নির্মাণ, যা থেকে প্রতিমাসে কয়েক লাখ টাকা উপার্জন করছেন। ঢাকার বাদামতলী, বনানী ও গুলশানে তার ৪টি বাড়ি রয়েছে। যার মূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা। তার দুই স্ত্রী ও তার নিজের নামে দেশে ও বিদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিভিন্ন একাউন্টে রয়েছে। দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ পাঁচার করেছে এই বাচ্চু শেখ।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন