শ ম রেজাউল করিম। মন্ত্রী, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের শুদ্ধি অভিযানের প্রসঙ্গ নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। দুর্নীতি নির্মূলে সবার অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বলেন, মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ছাড়া সমাজের উন্নয়ন সম্ভব নয়।
সরকারের চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযান ‘নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত’ উল্লেখ করে বলেন, যতদিন প্রয়োজন এ অভিযান চলবে। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে রাজনীতি ও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কেও আলোকপাত করেন। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের শুদ্ধি অভিযান চলছে। দুর্নীতির ব্যাপকতার অভিযোগ আপনার মন্ত্রণালয়েও। দায়িত্ব নেয়ার বছর পার হতে যাচ্ছে আপনার। কেমন দেখছেন দুর্নীতির চিত্র…
শ ম রেজাউল করিম : দুর্নীতি নিধনের চিত্র দেখছি এখন। দুর্নীতির চিত্রও কম দেখছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন, সে বার্তা আমার মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে পৌঁছে দেয়া হয়েছে।
আমার মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১২টি অধিদপ্তর-সংস্থার সবাই জানতে পারছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান কী? কর্মকর্তা ও ঠিকাদাররা কঠোর অবস্থানের কথা জানছেন বলেই তারা আরও দায়িত্বশীল হতে সচেষ্ট হচ্ছেন। দুর্নীতির অভিযোগে আমরা ব্যবস্থা নিতেও শুরু করেছি।
জাগো নিউজ : কী ব্যবস্থা নিলেন?
শ ম রেজাউল করিম : আমার মন্ত্রণালয়ের ৯২ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বিভিন্ন অভিযোগে। এ ঘটনা আপনি কোনোভাবেই ছোট করে দেখতে পারবেন না। এর আগে এমন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
রাজউক হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিদপ্তর। হয়রানি বন্ধ করতে অটোমেশন পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। বাসায় বসেই মানুষ নকশা দাখিল করতে পারছেন। ৫৩ দিনের মধ্যে রাজউক আপনাকে মোবাইলে জানিয়ে দেবে যে, আপনার নকশা হয়ে গেছে অথবা এই এই কারণে হয়নি। ভূমির ছাড়পত্র নিতে ভীষণভাবে হয়রানি হতে হতো। এখন সাতদিনের মধ্যে ছাড়পত্র দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
জনবান্ধব করতেই সেবাকে সহজ ও হয়রানিমুক্ত করা হয়েছে। সবকিছুই ডিজিটাল ব্যবস্থার আওতায় এনে সময় নির্ধারণ করে দেয়া হচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় স্তরগুলো বাদ দেয়া হয়েছে। দালালদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
একসময় গণপূর্ত অধিদপ্তরে টেন্ডার নিয়ে মাফিয়া চক্রের মধ্যে গোলাগুলি হতো। এ জায়গায় আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে অনলাইন পদ্ধতির মাধ্যমে।
অভিযুক্ত প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিয়েছি। কোনো মিডিয়ায় অভিযোগ এলেই আমরা উচ্চপর্যায় থেকে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিচ্ছি। বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুন লাগার ঘটনায় উচ্চমানের তদন্ত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে ৬২ জনকে দোষী করা হয়েছে নানা পর্যায়ে। আমরা ৬২ জনকে বরখাস্ত করেছি।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্নীতির অভিযোগে ৩০ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। দায়িত্ব নেয়ার এক বছরও হয়নি। ৪৮ বছরের ইতিহাসে এত অল্প সময়ে ৯২ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ঘটনা আর আছে বলে আমার জানা নেই।
জাগো নিউজ : এফ আর টাওয়ারে আগুন লাগার পর ভবন নির্মাণে অনিয়ম বের করতে অভিযান পরিচালনা করলেন। সেই অভিযান কিন্তু থমকে গেল…
শ ম রেজাউল করিম : ভবন নির্মাণে অনিয়ম একদিনে হয়নি। পুরান ঢাকায় ৫০০ বছর আগে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে অনিয়মের মধ্য দিয়ে। আমি চাইলেই রাতারাতি সব সমাধান করতে পারছি না।
ঢাকায় ১ হাজার ৮১৮টি বহুতল ভবন পেয়েছি, যেখানে নিয়ম ভঙ্গ করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আমরা যখনই নোটিশ করি, তখনই সর্বোচ্চ আদালত স্থগিতাদেশ জারি করেন।
জাগো নিউজ : গণহারে স্থগিতাদেশ দেয়ার কারণ কী হতে পারে?
শ ম রেজাউল করিম : আদালত হয়তো নোটিশের যৌক্তিকতা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে চাইছে। আমরা অ্যাটর্নি জেনারেলকে নিয়োগ দিয়েছি। বেসরকারি আইনজীবী দিচ্ছি। অন্যান্য জায়গায় অবৈধ স্থাপনা ভেঙে দেয়ার কাজ চলছে। তবে একটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে, ঢাকা, গাজীপুর, সাভার, কেরানীগঞ্জ রাজউকের অধীন। বিশাল এরিয়া। আমাদের জনবল মাত্র ১ হাজার ৫০০। এর মধ্যে ২০০ পদ ফাঁকা আছে। ১ হাজার ৩০০ জনবল দিয়ে সবকিছু সময় মতো পরিচালনা করা সম্ভব হয় না।
ধরুন, গ্যারেজের জায়গায় একটি ব্যাংকের বুথ বসিয়ে দেয়া হলো। আমরা গিয়ে ভেঙে দিলাম। ছয় মাস পর ফের স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি জায়গায় তো আমার লোক বসে থাকতে পারে না। ধানমন্ডি পিলখানার কাছে একটি বাড়ি আমরা তিনবার ভেঙেছি। একজন আইনজীবী এ কাজটি করলেন।
জাগো নিউজ : এমন চিত্র তো সর্বত্রই এবং সেটা রাজনৈতিক ক্ষমতা বলেই…
শ ম রেজাউল করিম : দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে না পারা হচ্ছে আমাদের বড় ব্যর্থতা। ব্যবস্থাপনারও দায় রয়েছে। আপনি রাজউককে দায়িত্ব দিলেন, অথচ জনবল দিলেন না, এটা তো সঠিক ব্যবস্থাপনা হলো না। রাজউক চেয়ারম্যান বা সদস্যরা তো প্রতিনিয়ত মাঠে থাকতে পারছেন না। মানুষ যদি তার নৈতিকতাবোধ হারিয়ে ফেলে তখন সরকারের পক্ষে সব করা সম্ভব হয় না।
আপনার বাড়ির পাশে কেউ যদি মুক্ত জায়গা দখল করে, আপনারও দায়িত্ব আছে সেখানে বাধা দেয়ার। সরকার বায়বীয় বিষয় নয়। নাগরিক নিয়েই সরকার।
জাগো নিউজ : নাগরিক কি বাধা দেয়ার ক্ষমতা রাখে? রাজনীতি তো নাগরিকের অধিকার ক্ষুণ্ন করছে…
শ ম রেজাউল করিম : রাজনীতির ওপর দোষ দিয়ে আপনি দায় এড়িয়ে যেতেই পারেন। কিন্তু নাগরিক তার সঠিক দায়িত্ব পালন করছে কি-না, সেটাই প্রশ্ন।
রাজনৈতিক শক্তির কারণেই দুর্বৃত্তায়ন ঘটছে শুধু, আমি তা বলব না। নানা রকম শক্তি কাজ করছে। রাজনৈতিক শক্তি, অর্থের প্রভাব, সামাজিক প্রভাব সবই কাজ করে। আবার দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কারণেই দুর্বৃত্তায়ন বাড়ছে। এক জায়গায় হানা দিয়ে পরের দিন আর যায় না। দুর্নীতির কারণেই আর তাগিদ দেয় না। তার মানে সম্মিলিতভাবে এটি ঘটছে।
এ পরিস্থিতি উপলব্ধি করেই প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করেছেন। তিনি কিন্তু এ অভিযানে কাউকে ছাড় দিচ্ছেন না। আত্মীয়, দলের নেতা কেউ ছাড়া পাচ্ছেন না।
জাগো নিউজ : দুর্নীতি আগে থেকেই হচ্ছে বলছেন। কিন্তু বালিশকাণ্ডের দুর্নীতি আপনাকে অবাক করেছে কি-না?
শ ম রেজাউল করিম : এমন কাণ্ড আজকের নয়। বহু আগের কাহিনি। আমি দায়িত্বে আসার পর ব্যবস্থা নিচ্ছি। বালিশ কেলেঙ্কারির বাইরেও বহু ঘটনা আছে। চট্টগ্রামের কাহিনি দেখলেন। ফরিদপুরের পর্দার ঘটনাও দেখলেন। আমরা কিন্তু বসে নেই।
জাগো নিউজ : বলছিলাম, দুর্নীতির ভয়াবহতা আপনাকে অবাক করেছে কি-না?
শ ম রেজাউল করিম : না। দুর্নীতির ভয়াবহতা আমাকে অবাক করেনি। কারণ, দুর্নীতি এখন থেকে হচ্ছে না। ১৯৪৭ সালে দুর্নীতি নিবারণের জন্য আইন হয়েছে। তার মানে, আগে থেকেই দুর্নীতি হয়ে আসছে।
এ রাষ্ট্রের সরকারপ্রধান (সাবেক) বেগম খালেদা জিয়া দুর্নীতির দায়ে জেল খাটছেন। তার পুত্রের কারাদণ্ড হয়েছে দুর্নীতির কারণে।
আমরা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা করছি। এ সরকারের একজন এমপির সাজা হয়েছে দুর্নীতির কারণে। তার মামলা প্রত্যাহার করা হয়নি। আমরা কাউকে ছাড় দিচ্ছি না। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।
জাগো নিউজ : এ চেষ্টায় আপনি কি তৃপ্ত?
শ ম রেজাউল করিম : এর বাইরে কী করা যেতে পারে? রাতারাতি তো সব দূর করা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, অভিযান চলবেই। সে যেই হোক; সরকারের লোক, আমলাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নজিরবিহীন ঘটনা আপনি ইতিপূর্বে দেখাতে পারবেন না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন