গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ‘পুনরুদ্ধার’সহ বিরাজমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে দেশের বাম ও উদারপন্থী দলগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। ওই ঐক্য সম্ভব হলে তার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চাইছে বিএনপিও। তবে সম্ভাব্য ঐক্যপ্রক্রিয়ার ওই আলোচনা এখনো অনানুষ্ঠানিক ও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। দলগুলোর নেতারা ব্যক্তিগত পর্যায়ে আলোচনা করার পাশাপাশি ঐক্যের যৌক্তিকতা তুলে ধরছেন। সুধীসমাজের কিছু প্রতিনিধিও এ বিষয়ে নেপথ্যে ভূমিকা পালন করছেন।
সুধীসমাজের ওই প্রতিনিধিরা বলছেন, এখন যেভাবে দেশ চলছে তাতে ভোটাধিকারসহ সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ এমনও বলছেন, বিএনপিকে দোষারোপ করে তো প্রায় এক যুগ পার হতে চলেছে! এখন অন্তত গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে একত্রে মাঠে নামা দরকার। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সর্বশেষ নির্বাচনের পর অনানুষ্ঠানিক ওই আলোচনায় বামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে ‘উদারপন্থী’ দলগুলোর ঐক্যের কিছুটা সম্ভাবনা তৈরি হলেও বিএনপির বিষয়টি এখনো দূরে রয়ে গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক এ প্রশ্নে কিছুটা হতাশা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘বাম ও উদারপন্থী দলগুলোকে অনেকবার বলেছি আপনারা রাজনৈতিক কর্মসূচির কথা চিন্তা করুন। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন। তাঁরা বলেন, গুছিয়ে নেই। কিন্তু রাজনীতি থেকে দূরে থাকেন। তাহলে সমাধান কিভাবে আসবে?’
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা বাম ও ডানের ঐক্য চাই।’ তিনি বলেন, ‘উদারপন্থীরা তো আমাদের সঙ্গে আছেই। এখন বামপন্থীরা এলে সরকারের বিরুদ্ধে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে উঠতে পারে।’
অবশ্য বিএনপি ইস্যুতে বাম দলগুলোর মনোভাবও এক নয়। সিপিবির অবস্থান কঠোর হলেও অন্য দলগুলোর অবস্থান এ প্রশ্নে কিছুটা নমনীয় বলে জানা গেছে। গত ১৬ সেপ্টেম্বর নাগরিক ঐক্যের এবং ৭ সেপ্টেম্বর গণফোরামের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো সত্ত্বেও সিপিবির কোনো নেতা যাননি। তবে বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকী এবং বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক আমন্ত্রণ পেলে ওই সব দলের কর্মসূচিতে নিয়মিত যান।
জানা যায়, ব্যক্তিগত ভাবমূর্তির কারণে বিএনপির কিছু নেতার প্রতি বাম দলগুলোর ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ দলগুলোর মধ্যে ঘুরে-ফিরে জামায়াত ও তারেক রহমানের প্রসঙ্গ উঠছে। ওই দুই ইস্যুতে নেতিবাচক এমন ভাবনা রয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত দলগুলোর মধ্যেও। ফলে আলোচনা এক জায়গায় গিয়ে থেমে যাচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্ট নেতারা প্রকাশ্যে এ বিষয়ে মুখ খুলতে চাইছেন না। কারণ তারেক রহমান বিএনপির বাস্তবতা—এটি তাঁরা অস্বীকারও করতে পারছেন না। তাই ঐক্য বা জোট গঠন সম্ভব না হলেও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো ইস্যুতে যুগপৎ আন্দোলন করা যায় কি না—এমন আলোচনা দলগুলোর ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছে।
সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভোটাধিকার ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য সংগ্রাম এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর বাম দলগুলো নিজেদের মতো করে এ জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু এই আন্দোলনের কোনো পয়েন্টে অন্য কোনো দল যদি মাঠে নামে আমরা তাকে স্বাগত জানাব।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মাঠে নামলে একটা বিশেষ মুহূর্তে অটোমেটিক এক স্রোতে সব মিশে যেতে পারে। কিন্তু এ জন্য এখনই জোট করতে হবে এর কোনো মানে নেই।’
বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাম ও উদারপন্থীদের ঐক্য নিয়ে কথা অনেক দিন ধরে চললেও এর রূপ লাভ করতে কিছুটা সময় লাগবে।’ তিনি বলেন, ‘দ্বিদলীয় রাজনীতির সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির কারণে দেশে এখন এক ধরনের রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এই শূন্যতায় বাম ও উদারপন্থী দলগুলোর মধ্যে ঐক্য হলে বিকল্প শক্তি হিসেবে দাঁড়ানো সম্ভব।’ তিনি আরো বলেন, ‘লেফট অ্যান্ড লিবারেল ইউনিটির সঙ্গে সুধীসমাজের প্রগতিশীল অংশ যোগ দিলে শক্তি আরো বাড়ে। তবে বিষয়গুলো এখনো আলোচনার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে।’
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী মিত্রদের বাইরে উদারপন্থী দল হিসেবে কারো কারো কাছে পরিচিত হলো গণফোরাম, জেএসডি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও নাগরিক ঐক্য। গত বছর ১৩ অক্টোবর এই চারটি দলের সঙ্গে বিএনপি গড়ে তুলেছিল জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।
অন্যদিকে সিপিবি, বাসদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাসদ (মার্কসবাদী), গণসংহতি আন্দোলন, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন—এই আটটি দল মিলে গত বছরের ১৮ জুলাই গঠিত হয় বাম গণতান্ত্রিক জোট।
গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা মোট ২৮৮ আসন পেলেও বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট লাভ করে মাত্র আটটি আসন। অন্যদিকে বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট একটি আসনও পায়নি। ভোটের দিন বিকেলেই তারা ফল প্রত্যাখ্যান করে।
ভোটের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ না হলেও ইতিবাচক ভাবমূর্তির জন্য উদার ও বামপন্থী দলগুলোর সমাজে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে বলে মনে করা হয়। এ কারণেই জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোট থাকার পরও গত নির্বাচনের আগে ‘উদারপন্থী’দের সঙ্গে আলাদা জোট গড়ে বিএনপি। অন্যদিকে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে থেকে দলটি বামপন্থীদেরও কাছে টানার চেষ্টা করে। ২০১৩ সালের ৩০ অক্টোবর গুলশান কার্যালয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন সিপিবি ও বাসদ নেতারা। কিন্তু এখনো বিএনপির সঙ্গে বামপন্থীদের সুসম্পর্ক তৈরি হয়নি।
জানা যায়, এ ক্ষেত্রে আগে প্রধান বাধা ছিল জামায়াত; আর এখন যুক্ত হয়েছে তারেক রহমানকে নিয়ে আপত্তি। এ ছাড়া সন্ত্রাস, দুঃশাসন, লুটপাটতন্ত্র বন্ধ করা এবং সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী রাজনীতিসহ রাষ্ট্র পরিচালনব্যবস্থায় বেশ কিছু সংস্কার চাইছে ওই দলগুলো। আওয়ামী লীগকে হটিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় এলেই সেগুলো নিশ্চিত হবে এমনটি ভাবতে পারছে না বামপন্থীরা।
তবে গত প্রায় একযুগে আওয়ামী লীগ সরকারের ‘দুঃশাসনের’ কারণে বাম ও উদারপন্থীদের মধ্যে সরকারবিরোধী মনোভাব বেড়েছে। এমন পরিস্থিতির কারণেই বিএনপিসহ উদারপন্থী দল এবং সুধীসমাজের কিছু প্রতিনিধি বামপন্থীদের বোঝানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বামপন্থী দলগুলোকে অনেক দিন ধরে বলছি, তোমরা শুরুতেই বিএনপির সঙ্গে বসতে পারবা না। আগে ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে বসো। কিন্তু তারা অযথা সময় নষ্ট করছে। এই ঐক্য কবে হবে বলা মুশকিল।’
গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘দেশ রসাতলে যাওয়ার পরও বামপন্থীরা যদি মনে করে এখনো বিএনপির দোষেই সব কিছু হচ্ছে তাহলে বলার কিছু নেই।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ওনাদের বোঝানোর চেষ্টা করছি যে ঐক্যের দরকার নেই। কিন্তু গণতন্ত্র রক্ষার জন্য অন্তত যুগপৎ কিছু করলে অসুবিধা কী!’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘উদার ও বামের ঐক্য আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শেপ নেবে বলে আশা করছি।’
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘বৃহত্তর ঐক্যের কথা অনেক দিন ধরেই আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু প্রণিধানযোগ্য কোনো অগ্রগতি এখনো হয়নি। তবে চেষ্টা অব্যাহত আছে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন