নানা নাটকীয়তা শেষে দীর্ঘ ২৭ বছর পর সরাসরি ভোটে ছাত্রদলে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়েছে। সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন ফজলুর রহমান খোকন ও সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামল।
তারা দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিনের সিন্ডিকেট ভেঙে কাউন্সিলররা নতুন নেতৃত্ব নির্বাচিত করেন। সরাসরি ভোটে নেতা নির্বাচিত হওয়ায় সবাই ফলাফল মেনে নিয়েছেন, দেখা যায়নি কোনো প্রতিবাদ-বিক্ষোভও।
ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা এখন বেশ উজ্জীবিত। বিএনপি ও অঙ্গ-সংগঠনেও চাঙ্গাভাব। সফলভাবে ছাত্রদলের কাউন্সিল শেষ হওয়ায় বিএনপির হাইকমান্ডেও স্বস্তি ফিরে এসেছে।
তবে দলের একটি গ্রুপের দাবি, দীর্ঘদিনের সিন্ডিকেট মুক্ত হলেও ছাত্রদলের নেতৃত্ব এখন নতুন সিন্ডিকেটের কব্জায়। সিন্ডিকেটের শুধু হাতবদল হয়েছে মাত্র। নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনে ওই সিন্ডিকেট প্রকাশ্যে ভূমিকা পালন করে। তাদের আশীর্বাদপুষ্টরাই নতুন নেতৃত্বে এসেছেন। তবে সরাসরি ভোটে নেতা নির্বাচিত হওয়ায় তাদের এসব অভিযোগ মানতে নারাজ অনেকে। ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা সিনিয়র কারও অনুসারী হবেন এটাই স্বাভাবিক। নতুন নেতৃত্বও এর বাইরে নয়। তাই বলে তাদের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রিত নেতা বলা যাবে না।
বুধবার রাতভর দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের বাসায় ভোটগ্রহণ শেষে চলে গণনা। ভোর রাতে ঘোষণা করা হয় ফলাফল। নির্বাচিত সভাপতি ফজলুর রহমান খোকনের বাড়ি বগুড়া ও সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামলের বাড়ি নরসিংদী। মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা মনে করেন, সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ সরকারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে সক্রিয় হওয়ার চ্যালেঞ্জ নতুন নেতৃত্বের সামনে।
সূত্র জানায়, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে আলোচনা করে শিগগিরই পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হবে। পূর্ণাঙ্গ কমিটিতেও থাকছে চমক। অতীতের মতো আর ঢাউস কমিটি করা হবে না। যোগ্য, ত্যাগী এবং রাজপথে সক্রিয় কর্মীরাই কমিটিতে প্রাধান্য পাবেন। সভাপতি পদে পরাজিত নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণকে সিনিয়র সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে পরাজিত জাকিরুল ইসলাম জাকিরকে এক নাম্বার যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক করার চিন্তা রয়েছে। এছাড়া পরাজিত অন্যদেরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হবে।
জানতে চাইলে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও ছাত্রদলের কাউন্সিলের রিটার্নিং কর্মকর্তা ফজলুল হক মিলন যুগান্তরকে বলেন, বিএনপি পুনর্গঠনে ছাত্রদলের কাউন্সিলকে আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম। সেই চ্যালেঞ্জে জয়ী হয়েছি।
ভোটে ছাত্রদলের নেতৃত্ব নির্বাচনে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। ফলে নেতাকর্মীদের মধ্যে চাঙ্গাভাব ফিরে এসেছে। এটাকে রোল মডেল ধরে অন্য ইউনিটেও ভোটে নেতা নির্বাচনের দাবি জোরালো হচ্ছে।
এর মধ্য দিয়ে যোগ্য ও ত্যাগীরা নেতৃত্বে আসার সুযোগ পাবেন। জানতে চাইলে ছাত্রদলের নবনির্বাচিত সভাপতি খোকন ও সাধারণ সম্পাদক শ্যামল যুগান্তরকে বলেন, সরাসরি ভোটে নেতা নির্বাচিত করার উদ্যোগ নেয়ায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। কাউন্সিলররা যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা চ্যালেঞ্জিং। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আমরা সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কাজ করব। এটা আমাদের জন্য অসম্ভব বলে মনে করি না।
তারা বলেন, নানা রাজনৈতিক কারণে ছাত্রদল তাদের অতীত ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারেনি। সেই ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে আপ্রাণ চেষ্টা করব। রাজপথে থেকে বিএনপির ভ্যানগার্ড হিসেবে কাজ করব। এ মুহূর্তে দলের চেয়ারপারসনের মুক্তির আন্দোলন ত্বরান্বিত ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম বেগবান করাই অন্যতম লক্ষ্য। শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনা, মুক্তচিন্তার পরিবেশ সৃষ্টি, হলে সব সংগঠনের সহাবস্থান নিশ্চিতে আমরা ছাত্রসমাজকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করব। এক প্রশ্নের জবাবে নতুন দুই নেতা বলেন, ছাত্রদলে কোনো সিন্ডিকেট নেই। আমরা সবাই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল।
পরাজিত সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী জুয়েল হাওলাদার নতুন নেতৃত্বকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, তারেক রহমানের দলে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমেই সুগম হবে দেশের সামগ্রিক গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন।
১৪ সেপ্টেম্বর ছাত্রদলের ষষ্ঠ কাউন্সিল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সংগঠনের সাবেক এক নেতার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত কাউন্সিলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ফলে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে কাউন্সিল। এরই মধ্যে কাউন্সিলরদের ঢাকায় তলব করা হয়। তারা বৈঠক করে ছাত্রদলের সাংগঠনিক দায়িত্ব ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ওপর ছেড়ে দেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দলের সিনিয়র নেতা ও আইনজীবীদের সঙ্গে কাউন্সিল নিয়ে পরামর্শ করেন।
কাউন্সিলে আইনি বাধা নেই- আইনজীবীদের এমন পরামর্শের পর দ্রুত তা করার উদ্যোগ নেয়া হয়। বুধবার সব কাউন্সিলরকে ঢাকায় আসতে বলা হয়। নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কাউন্সিলর ও ছাত্রদলের সাবেক নেতাদের সঙ্গে স্কাইপে কয়েক দফা বৈঠক করেন তারেক রহমান।
পরবর্তীতে বুধবার রাতেই ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। নয়াপল্টনে কাউন্সিলরদের স্থান সংকুলান হবে না ভেবে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের বাসায় ভোট নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। রাত পৌনে ৯টায় সেখানে শুরু হয় ভোটাভুটি। বিরতি ছাড়াই চলে রাত পৌনে ১টা পর্যন্ত। পরে গণনা শেষে ফল ঘোষণা হয়।
সর্বশেষ ১৯৯২ সালে ভোটে ছাত্রদলের নেতা নির্বাচিত হয়। রুহুল কবির রিজভী সভাপতি ও ইলিয়াস আলী সাধারণ সম্পাদক হন। কিন্তু এরপর থেকেই সিন্ডিকেট তৎপর হয়ে ওঠে। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে নির্বাচিত কমিটি ভেঙে দিতে বাধ্য করে সিন্ডিকেট। এরপর দীর্ঘ ২৭ বছরই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে ছিল ছাত্রদল। অযোগ্য, নিষ্ক্রিয় ও তাদের আস্থাভাজনদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আনা হয়েছে; যাতে সংগঠনটি নিজেদের কব্জায় থাকে।
ফলে যোগ্য ও সাহসীরা ছাত্রদল করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। সিন্ডিকেটের কব্জায় থাকায় ঐতিহ্যবাহী এ সংগঠনটি দিন দিন তাদের ঐতিহ্য হারাতে শুরু করে। রাজপথে বিএনপির ভ্যানগার্ড হিসেবে পরিচিত ছাত্রদল একসময়ে দলের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসনে হিমশিম খেতে হয় হাইকমান্ডকে। এমন অবস্থায় সংগঠনের ঐতিহ্য ফেরাতে সিন্ডিকেট মুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। পরে সরাসরি ভোটে নেতা নির্বাচনের উদ্যোগ আলোর মুখ দেখে।
৯ জন সভাপতি এবং ১৯ জন সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মধ্যে দুই পদে দুজনকে বেছে নিতে ভোট দেন ছাত্রদলের ১১৭টি সাংগঠনিক শাখার ৫৩৪ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ৪৮১ জন। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে সভাপতি হয়েছেন খোকন। তিনি পেয়েছেন ১৮৬ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণের ভোট ১৭৮। খোকন ঢাবির সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। তিনি সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের আবাসিক ছাত্র। ছাত্রদলের গত কমিটিতে গণশিক্ষা বিষয়ক সহ-সম্পাদক ছিলেন তিনি। তার গ্রামের বাড়ি বগুড়া জেলায়। কাউন্সিলের শুরুতে সভাপতি হিসেবে এগিয়ে ছিলেন শ্রাবণ। কিন্তু তার পরিবারের সদস্যরা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় তার জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। তাছাড়া শ্রাবণ ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন টুকুর অনুসারী। দলের বড় অংশ টুকুর সিন্ডিকেট থেকে ছাত্রদলকে মুক্ত করতে ঐক্যবদ্ধ হয়। যার প্রভাব পড়ে ভোটে। সভাপতি হিসেবে শুরুতে খোকন আলোচনায় থাকলেও দিন দিন তার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। উত্তরবঙ্গের সবাই তার পক্ষে মাঠে নামেন। উত্তরবঙ্গে মোট ভোটার ১২৫; যার বেশিরভাগই খোকন পায়। শেষ মুহূর্তে ৮ ভোটের ব্যবধানে সভাপতি নির্বাচিত হন খোকন।
সাধারণ সম্পাদক পদে শ্যামল পেয়েছেন ১৩৯ ভোট। তার নিকতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাকিরুল ইসলাম পেয়েছেন ৭৪। শ্যামল ঢাবির তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র। তিনি ঢাবির ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।
ছাত্রদলের সদ্যবিদায়ী সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসানের অনুসারী শ্যামল। তার বাড়ি নরসিংদী জেলায়। বড় বড় সিন্ডিকেটের প্রার্থীকে হারিয়ে অনেকটা চমক দেখান শ্যামল। সাধারণ সম্পাদক পদে ১৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
এদের মধ্যে শাহ নাওয়াজের পক্ষে চট্টগ্রাম বিভাগের নেতারা একজোট হন। সাইফ মাহমুদ জুয়েলের পক্ষে ছিলেন বরিশাল অঞ্চলের সাবেক কয়েকজন ছাত্রদল নেতা। আমিনুর রহমান আমিন খুলনা অঞ্চলের। তার পক্ষে শক্ত অবস্থান নেন ছাত্রদলের সাবেক সভাপতিসহ আরও কয়েক নেতা।
খুলনা বিভাগের আরেক প্রার্থী আবু তাহের। তার পক্ষে কাজ করেন ছাত্রদলের বিলুপ্ত কমিটির এক নেতা। জাকিরুল ইসলাম জাকিরের বাড়ি নেত্রকোনায়। তার পক্ষে ছিলেন ছাত্রদলের বিলুপ্ত কমিটির আরেক শীর্ষ নেতা এবং ছাত্রদলের সাবেক এক নেতা। তিনি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পান।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন