বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মকাণ্ডের ফলে মানুষের কাছে এই দুই সংগঠন পরিত্যক্ত হয়ে যাবে বলে মনে করেছিলাম। কারণ তাদের অনাচারে সমাজ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ চারদিক থেকে। তারা যে শুধু বিশেষ বিশেষ প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করেছে তা নয়, সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের অনাচারের হাত সম্প্রসারিত হয়েছে। শাহবাগের ছোট ছোট ফুলের দোকানগুলো পর্যন্ত তাদের দৃষ্টি এড়ায়নি। নিউমার্কেটের টেম্পু স্টেশন, রাজধানীর ফুটপাতও তাদের ‘জমিদারিভুক্ত’। তাদেরকে সবাই রোজ রোজ আরোপিত খাজনা-ট্যাক্স বুঝিয়ে দিতে হয়। মাদক, মদ-জুয়ার আসর বসিয়ে ব্যবসায়ও নেমেছে তারা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের টাকার পার্সেন্টেজ দাবি করতে গিয়ে ঘটনাটা উপাচার্য প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করায় খোলামেলাভাবে বাজারে এসেছে। এমন আরও কত খবর, কত প্রতিষ্ঠানের পড়ে আছে, মিডিয়ায় আসছে না বলে অনেকে জানে না। প্রধানমন্ত্রী তদন্ত করে একটা ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছেন। ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। যুবলীগের কিছু শীর্ষ তোলাবাজকেও সাজা দেওয়া হবে শুনছি। ঢাকায় দুই-চারজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।
এটা নিয়ে এখন হইচই হবে। নেতারা গরম গরম বক্তৃতা দেবেন। আর জিরো টলারেন্সের কথা বলবেন। তারপর সব মিলিয়ে যাবে। কোথায় গেলো শেখ আবদুল হাই বাচ্চু? বেসিক ব্যাংক ডুবিয়ে দিয়ে চলে গেলেন তিনি। কোথায় গেলেন মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাহেব? ফারমার্স ব্যাংকে লাল বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে দিব্যি সুখে শান্তিতে আছেন। কিছু হয়েছে বলে তো শুনিনি।
প্রতিবছর সরকারি ব্যাংকগুলোকে বার্ষিক বাজেটে মূলধন সরবরাহ করতে হয়। টাকা যায় কোথায়? ঋণখেলাপি তো হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান নয়। তাদের সঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনা করে ঋণখেলাপি হওয়ার কারণ উদ্ঘাটন করে তার বাস্তবসম্মত একটা সমাধান বের করার প্রয়োজন ছিল। খেলাপি সংস্কৃতি অব্যাহতভাবে চলতে দিলে তো ব্যাংকগুলো পঙ্গু হয়ে যাবে।
বর্তমান অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামালের বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে। মনে করেছিলাম তিনি তেমন একটা উপায় বের করবেন। কিছুই তো করতে পারছেন না। এখন বলছেন হলমার্কের দিকে নাকি দৃষ্টি ফেরাবেন। দৃষ্টি ফেরালে হই-হল্লা করে তাকে ডুবালেন কেন আগে! একবার ডুবাবেন আরেকবার তুলে নেওয়ার চেষ্টা করবেন, এমন খামখেয়ালিপনা দিয়ে তো কোনও কিছুই সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে না। রাষ্ট্র তো দূরের কথা।
হলমার্কের নাকি ৬০ হাজার কর্মচারী ছিল। সে সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে চার-পাঁচ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে নিয়ে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল। অনেক অনিয়ম ছিল সত্য, কিন্তু সে তো টাকা বিদেশে পাচার করেছে শুনিনি। লোকসান দিয়েও বসে ছিল না। সে তো ৬০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান করেছিল। বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করছিল। শুনেছি সে নাকি সাড়ে তিন হাজার টাকা বেতনের গার্মেন্টসের কর্মচারী ছিল একসময়। তাহলে বলতে হয় তার দক্ষ এন্ট্রাপ্রেনারশিপ ছিল। এন্ট্রাপ্রেনারশিপও একটা রেয়ার কোয়ালিটি। অর্থনীতির ভাষায় এটা মূলধন।
যখন হলমার্কের অনিয়মের কথা প্রকাশ পেলো, তখনই তো সরকারের উচিত ছিল সব অনিয়মকে নিয়মের মধ্যে এনে তাকে তার প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে দেওয়া। সে তো ঋণ নিতে কিছু অনিয়ম করেছিল। ব্যাংক থেকে তো ডাকাতি করে টাকা নেয়নি। পাকিস্তানের সময়ে যে অনুরূপ কিছু ঘটনা ঘটতো না তা নয়, কিন্তু তারা তথ্য উদঘাটিত হলে সবকিছু নিয়মিত করে ফেলতো। আর ব্যাংক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতো। এখন হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের সঙ্গে জড়িত কোনও ব্যাংক কর্মকর্তার সাজা হতে তো দেখি না।
হলমার্কের ব্যাপারে অবশ্য অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব কিছু একটা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মিডিয়ার কারণে করতে পারেননি। এক মিডিয়া তো লিখেই বসলো তারল্য সংকট দেখা দেবে। যেমন আমরা, তেমন আমাদের মিডিয়া। বাতাস বইলেই তুফান সৃষ্টি করে। এখন আমও গেলো, ছালাও গেলো। সরকারের চার-পাঁচ হাজার কোটি টাকা আটক হয়ে গেলো।
যা হোক, ছাত্রলীগ-যুবলীগ প্রসঙ্গে আসি। নিজেও এক সময় ছাত্রলীগের কর্মী ছিলাম। এখনকার অবস্থা দেখলে ব্যথিত হই। হেঁটে হেঁটে সংগঠন করেছি। হাতে লিখে পোস্টার লাগিয়েছি। আর এখন পোস্টারে দেখি বাম কোনায় বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী আর জয়ের ছোট গ্রুপ ফটো। তার নিচে বড় বড় ফটো। ডানদিকে-বাঁদিকে আরও অনেক ছোট ছোট ফটো। বড়টা স্থানীয় মাস্তানের। ছোটগুলো তার সহকারী মাস্তানদের।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু যখন জাতির কাছে ছয় দফা পেশ করেন, তখন আমরা ছাত্রলীগের কর্মীরা কত কষ্ট স্বীকার করে ঘরে ঘরে গিয়ে ছয় দফা প্রচার করেছিলাম। ছয় দফা জোয়ার আসতো না যদি ছাত্রলীগের কর্মীরা ছয় দফার প্রচার প্রসার নিয়ে কঠোর পরিশ্রম না করতো। তখন আওয়ামী লীগের ব্যাপক কোনও কর্মীবাহিনী ছিল না।
ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত জেল খাটার পরিমাপ করলে মনে হয় এক হাজার বছর হবে। এমন ত্যাগী নেতাকর্মীদের সংগঠনের অবস্থা এখন এমন হলো কেন? ১৯৭৫ সালের পর যারা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারা এই দায় অস্বীকার করতে পারবেন না। বঙ্গবন্ধুর সময় দেখেছি তিনি সব সময় এক গ্রুপকে তৈরি করে রাখতেন। এক গ্রুপের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে আরেক গ্রুপকে বসিয়ে দিতেন। এতে নেতাও বের হয়ে আসতো, আবার নতুন এক গ্রুপের শিক্ষানবিশ সময়ও চলতো। ১৯৭৫ সালের পর বঙ্গবন্ধুর সেই প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়েছে।
এখন সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক খোঁজ করে বের করার জন্য সার্স কমিটিও গঠন করা হয়। কাউন্সিল হয় এক মাসে, আর তার দুই-তিন মাস পরে কমিটি ঘোষণা করা হয়। অনিয়মিত ব্যবস্থা। অথচ আমু, মতিয়া, তোফায়েল এরা সবাই ছাত্র সংগঠন থেকে মূল সংগঠনে এসেছেন। এরা ছিল সে সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা। প্রধানমন্ত্রী নিজেও ছাত্ররাজনীতি করেছেন।
প্রবীণ এসব নেতা কেন সংগঠন সম্পর্কে মাথা ঘামান না! তাদের কি সভানেত্রী এড়িয়ে চলেন, না তারা সভানেত্রীকে সহযোগিতা করেন না—তাও বুঝি না। গতবার মন্ত্রিসভা গঠন করার সময় আমু, মতিয়া, তোফায়েল, ইনু, মেননকে বাদ দিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করা হলো। এই অভিজ্ঞ লোকগুলোকে কেন বাদ দেওয়া হলো, তাও বুঝে আসে না। অথচ তারা ভারতের মতো দেশেও মন্ত্রিসভার মন্ত্রী হওয়ার উপযুক্ত লোক। মন্ত্রিসভায় কচিকাঁচার মেলা নয়, ধার-ভারসম্পন্ন লোক নিয়ে তো মন্ত্রিসভা গঠন করতে হয়। নয়তো দেশে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে মোরারজি দেশাইয়ের দ্বিমত লেগেই থাকতো। ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের সময় স্বর্ণালংকার অধিগ্রহণ আইন প্রণয়নের জন্য যখন মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বৈঠকে বসে, তখন অর্থমন্ত্রী হিসেবে মোরারজি দেশাই এই আইন প্রণয়ন না করার পক্ষে অবস্থান নেন। কিন্তু মন্ত্রিসভা যখন শেষ পর্যন্ত অধিগ্রহণের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তখন মোরারজি দেশাই সেই আইন অর্থমন্ত্রী হিসেবে প্রণয়ন করে লোকসভায় উত্থাপন করেন এবং দীর্ঘ সময়ব্যাপী বিলের পক্ষে তিনিও বক্তৃতা করেন। কিন্তু উপসংহারে তিনি বলেছিলেন অর্থমন্ত্রী হিসেবে আমি এই বিল লোকসভায় উত্থাপন করেছি, কিন্তু আমি এই বিলের বিরুদ্ধে এবং আমাকে যদি ভোট দিতে বলা হয়, আমি বিরুদ্ধেই ভোট দেবো।
লোকসভা অধিবেশন শেষ হলে কংগ্রেস পার্লামেন্টারি পার্টি জরুরি বৈঠকে বসে মোরারজিকে শায়েস্তা করার জন্য। লোকসভায় কংগ্রেস দলীয় ১৫-১৬ জন সদস্য এই বিষয়ে বক্তৃতা করেন এবং পার্লামেন্টারি পার্টি মোরারজি দেশাইকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়ার পক্ষে প্রায় একমত হয়েছিলেন। কিন্তু নেহরু সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন আমি মোরারজি দেশাইকে জানি। কুতুবমিনারের মাথার ওপর গান্ধী টুপি পরালে তার সঙ্গে শুধুই মোরারজির তুলনা চলে। আর সত্য ভাষণের জন্য কারও শাস্তি হলে তো সভ্যতা বিলুপ্ত হবে।
মোরারজি দেশাইদের কারণে নেহরু ১৭ বছর প্রধানমন্ত্রিত্ব করার পরও কোনও বিভ্রান্তিতে ভোগেননি, আর রাষ্ট্রের মাঝেও কোনও অরাজকতা দেখা দেয়নি।
পরিশেষে প্রধানমন্ত্রীকে সবিনয় অনুরোধ করবো, তিনি যেন সবকিছু ভুলে গিয়ে প্রবীণ নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে দল ও তার অঙ্গ-সংগঠনগুলো পুনর্বিন্যাস প্রক্রিয়ার কাজ করেন। দলের শুদ্ধি অভিযানের একটা নকশা তৈরি করেন। আপনারও বয়স হচ্ছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। একার পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব নয়। সর্বোপরি সবকিছু নিয়ে মানুষের মাঝেও অসন্তোষ সৃষ্টি হচ্ছে। সেদিকেও দৃষ্টি রাখা দরকার।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন