সরকারের টানা দ্বিতীয় মেয়াদের ১০ বছরের ধারাবাহিকতায় বিপুলসংখ্যক নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত এসেছে। বর্তমানে চলছে তৃতীয় মেয়াদ। কিন্তু গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সময় লাগছে বেশি। ফলে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নই বর্তমানে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমান সরকারের প্রথম ত্রৈমাসিক অর্থাৎ গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত মন্ত্রিসভার বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত ছিল ৩৬টি। গত বছর একই সময়ে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত ছিল ৬৩টি। এর আগের দুই বছরের মন্ত্রিসভা বৈঠকে নেওয়া সিদ্ধান্তের যে তুলনামূলক চিত্র পাওয়া যায়, তা চলতি বছর ও গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। ২০১৬ ও ২০১৭ সালের ‘অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর’ ত্রৈমাসিক মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হারের তুলনামূলক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসে আটটি মন্ত্রিসভা বৈঠকে সিদ্ধান্ত এসেছিল ৬৮টি। ২০১৬ সালের একই সময়ে ১০টি মন্ত্রিসভা বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল ১১৬টি। উল্লিখিত চারটি বছরে মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্তগ্রহণের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক কমে আসার চিত্র ফুটে উঠেছে।
টানা ক্ষমতায় থাকায় সরকারের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত কমে আসাকে স্বাভাবিক বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য সিনিয়র সচিব শামসুল আলম গত ১০ বছর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার কারণে সরকার পরিকল্পনায় থাকা অনেক সিদ্ধান্ত পর্যায়ক্রমে সহজেই নিতে পেরেছে। যেমন—অনেক আইন, বিধিমালা, অ্যাকশন প্ল্যান, মাস্টারপ্ল্যান ও কর্মপরিকল্পনা এই সরকার নিয়ে ফেলেছে। ফলে পর্যায়ক্রমে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত কমে যাওয়াই স্বাভাবিক।’ তাঁর মতে, সামনের দিনে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডে থাকা বাংলাদেশের যুবশক্তির জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ছিল সরকারের অন্যতম প্রতিশ্রুতি। ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের তথ্যানুযায়ী খোদ সরকারই তার বিভিন্ন দপ্তরে থাকা শূন্যপদ পূরণ করতে পারেনি। উল্টো বছর বছর শূন্যপদ বাড়ছে। ‘স্ট্যাটিসস্টিকস অব সিভিল অফিসার স্টাফ’ প্রতিবেদনে ২০১৩ সালে সরকারি শূন্যপদ ছিল দুই লাখ ৭৬ হাজার ৫৮৭টি। সর্বশেষ প্রকাশিত হওয়া ২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী শূন্যপদ বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৯৯ হাজার ৮৯৭টি।
টানা ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার এক দশকের প্রথমেই যে কয়টি গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে মৃতপ্রায় উপজেলা পরিষদকে জীবিতকরণ। কিন্তু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের সংসদ সদস্যদের প্রভাবমুক্ত রাখার দাবি উপেক্ষিত থেকেছে। সিটি করপোরেশনগুলোতে ‘নগর সরকার’ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এ কারণে ডজনখানেক সংসদ সদস্যের এলাকা নিয়ে গঠিত সিটি মেয়রদের ‘ট্রেড লাইসেন্স মন্ত্রী’ হিসেবে অনেকে অভিহিত করে। অর্থাৎ ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া ছাড়া বড় কোনো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে গেলে সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় মেয়রদের। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের অবস্থা আরো খারাপ। কুড়িগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান
জাফর আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যে উৎসাহ-উদ্দীপনার স্বপ্ন মানুষকে দেখিয়েছিলাম, তা আর বাস্তবায়ন করার উপায় দেখছি না।’
বিগত সব কটি সংসদ নির্বাচনের সব ইশতেহারে যে বিষয়গুলো ‘কমন’ প্রতিশ্রুতি হিসেবে স্থান পেয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘দুর্নীতি রোধ’। গত নির্বাচনের সময় দেওয়া ইশতেহারে আওয়ামী লীগ ইস্যুভিত্তিক অঙ্গীকারের সঙ্গে ২০টি ‘বিশেষ অঙ্গীকার’ করেছে। এর মধ্যে ১ নম্বরে আছে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ’। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণা সূচক প্রতিবেদনের ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পাওয়া চার বছরের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশ শতকরা ২৫ থেকে ২৮ পর্যন্ত স্কোর তুলতে পেরেছে, যা বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর কাতারের চিত্র।
গত ১০ বছরে অন্যতম চমক হিসেবে চোখে পড়েছে মেগা প্রকল্প। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ১০টি বড় প্রকল্প ‘ফাস্ট ট্র্যাক’ গতিতে বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয় সরকার। এর মধ্যে পদ্মা সেতু ও মেট্রো রেল প্রকল্পে দৃশ্যমান অগ্রগতি থাকলেও প্রতিশ্রুত সময়ের চেয়ে বেশি সময় লাগছে বাস্তবায়নে। অন্য আটটি প্রকল্পের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পদ্মা রেল সেতু, দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুনধুম রেলপথ, পায়রা সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের অগ্রগতি ধীর। এলএনজি টার্মিনাল, মহেশখালী-মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের অবস্থাও ঢিমেতালে চলছে। এর বাইরে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর করার বিষয়ে দীর্ঘ জল্পনা-কল্পনা থাকলেও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতার কারণে প্রকল্পটি শুরুই হয়নি।
সিদ্ধান্ত নেয় সরকার, বাস্তবায়ন করে প্রশাসন। আমলাদের কাজের পদ্ধতি নিয়ে কৌতূহলী একটি তথ্য জানা গেল গত সপ্তাহে সচিবালয়ের ৪ নম্বর ভবনে একজন প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরে আসা সাবেক এক মন্ত্রীর মুখে। টেবিলটকে সাবেক ওই মন্ত্রী বলেন, ‘গত পাঁচ বছর মন্ত্রণালয়ে যেসংখ্যক বৈঠক করেছি, তাতে কাজ বাস্তবায়নের সময়ই তো পাইনি।’
প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সিনিয়র সচিব শামসুল আলম বলেন, একসময় নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতার অভাব ছিল, সেটা কেটেছে। এখন প্রকল্প বাস্তবায়নে কিছু জটিলতা আছে স্বীকার করতে হবে। তিনি বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি বড় হয়েছে। প্রকল্পের বৈশিষ্ট্যে মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। আমাদের দক্ষ জনশক্তি সেভাবে গড়ে ওঠেনি। তাই এই জায়গার দুর্বলতা কেটে উঠতে কিছুটা সময় লাগবে।’
চলতি সংসদের প্রথম অধিবেশনে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর দেওয়া বক্তৃতায় গত ৬ মার্চ বলেন, ‘আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ঠিক সময়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে না দক্ষতার অভাবে। পর্যাপ্ত অর্থ ব্যয় করলেও দক্ষ জনবল গড়ে উঠছে না বলে ক্ষোভও প্রকাশ করেন সাবেক এই তথ্যমন্ত্রী।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন