হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন জাতীয় পার্টির একক ক্ষমতার মালিক। দলটির গঠনতন্ত্রও তাঁকে একক ক্ষমতা দিয়েছে। তিনি ঘন ঘন সিদ্ধান্ত বদলেছেন, এ নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে, তবে দলের নেতাকর্মীরা নীরবে মেনে নিয়েছে তাঁর সিদ্ধান্ত। এরশাদবিহীন জাতীয় পার্টিতে এমন কোনো নেতা কি আছেন যার সিদ্ধান্ত বিনা প্রতিবাদে মেনে নেবে নেতাকর্মীরা? এমন প্রশ্নের জবাবে সংগঠনের বেশির ভাগ নেতাকর্মী জানিয়েছে, না নেই। তাদের মতে, এরশাদের সমকক্ষ কোনো নেতা নেই জাতীয় পার্টিতে। তবে নেতাকর্মীরা বলছে, রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরের মধ্যে ঐক্য থাকলে এরশাদের জনপ্রিয়তার ওপর ভিত্তি করে এগোতে পারে জাতীয় পার্টি।
এরশাদ সব শেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাঁর সহধর্মিণী রওশন এরশাদকে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা করেছেন এবং ওই পদ থেকে ছোট ভাই জি এম কাদেরকে সরিয়ে দিয়েছেন। জি এম কাদেরকে করেছেন জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। দলের দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদই রেখেছেন পরিবারের মধ্যে। বাংলাদেশের বাইরেও উপমহাদেশের রাজনীতিতে পারিবারিক উত্তরাধিকারের রাজনীতি বলবৎ আছে। এরশাদও হয়তো চিন্তা করেছেন, জাতীয় পার্টিকে টিকিয়ে রাখতে হলে পারিবারিক উত্তরাধিকারের বিকল্প নেই। এ ছাড়া জাতীয় পার্টি প্রধানত এরশাদের জন্মস্থান রংপুরের ওপর নির্ভরশীল একটি রাজনৈতিক দল। জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব রংপুরের হাতে থাকলে দলটি টিকে থাকার সম্ভাবনা থাকে।
রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের একই পরিবারের লোক। দুজনই এরশাদের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের বৈধ দাবিদার। জাতীয় পার্টির জনসমর্থন এরশাদকেন্দ্রিক হলেও এ দুজন সে সমর্থনের ভাগ পেতে পারেন। রওশন-জি এম কাদের দুই মেরুতে অবস্থান করলে জাপার ভাগ্যবিপর্যয় অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে।
এরশাদের জীবনকালেই ক্ষীণ হলেও দুটি ধারা বহমান ছিল জাতীয় পার্টিতে। এরশাদের বাইরে আরেকটি ধারা হলো রওশন এরশাদকেন্দ্রিক। জি এম কাদেরকে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার পর দলের নাখোশ একটি অংশ নতুন করে ভর করে রওশন এরশাদের ওপর। জি এম কাদের দলের কোনো কর্মসূচি দিলে সেখানে অনুপস্থিত থাকেন রওশন এরশাদসহ এই নেতারা। রুহুল আমিন হাওলাদারকে জাপার মহাসচিব পদ থেকে সরিয়ে মশিউর রহমান রাঙ্গাকে মহাসচিব করার পর রুহুল আমিনের সমর্থকরাও এরশাদকে ছেড়ে ঝুঁকেছেন রওশনের দিকে। এরশাদের জীবদ্দশাতেই জাপায় গ্রুপিং সৃষ্টি হয় পরিবারের লোককেন্দ্রিক। তবে এরশাদের ব্যক্তিত্বের কারণে গ্রুপিং মাথাচাড়া দিতে পারেনি। এখন এরশাদ নেই। দেবর-ভাবির বিরোধ জিইয়ে থাকলে বিস্তৃত হতে পারে জাতীয় পার্টির ভাগাভাগি।
এরশাদের একটি পারিবারিক সূত্র জানায়, রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরের বিরোধ বাধিয়ে রাখতে এরশাদের কজন নিকটাত্মীর জোরালো ভূমিকা রেখেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এরশাদের একজন নিকটাত্মীয় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এরশাদ জীবিত থাকার সময় পরিস্থিতি এক রকম ছিল, আমাদের ভরসার জায়গা ছিল। এখন নিশ্চয়ই আত্মীয়স্বজনরা বুঝবেন বিরোধে জাতীয় পার্টি ভাগাভাগি হলে তাঁদের কোনো লাভ নেই।’
এরশাদবিহীন জাতীয় পার্টির অবস্থান কেমন হতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জের। এরশাদবিহীন জাতীয় পার্টিকে কঠিন সময় ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগ শক্তিশালী হয়েছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে। বাস্তবে জাতীয় পার্টি তো ওই রকম আদর্শভিত্তিক দল নয়। এ ছাড়া এরশাদ যেভাবে দলটিকে সংগঠিত করে সামনে এগিয়ে এনেছেন, সেটা তো অন্য কারো পক্ষে সহজ হবে না। আমরা হয়তো টিকে যাব, তবে এরশাদের অবর্তমানে একটা বড় ধরনের ধাক্কা আসবে। তবে বর্তমানে জাতীয় পার্টিতে অনেক দক্ষ, জনপ্রিয়, পোড়খাওয়া অভিজ্ঞ নেতা আছেন। আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারলে, এরশাদ সাহেবের পরিবারের মধ্যে ভাগাভাগি না হলে, আমরা বেশ ভালোভাবেই টিকে থাকব, এগিয়ে যাব।’
এরশাদবিহীন জাতীয় পার্টির অবস্থা কেমন হবে জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জি এম কাদের কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা প্রতিটি মানুষের নির্দিষ্ট আয়ু বেঁধে দিয়েছেন, সে আয়ু শেষ হলে তিনি আর বাঁচবেন না, এটাই বিধান। এরশাদ সাবেক রাষ্ট্রপতি ছিলেন, তাঁর সময়ে দেশে অনেক জনকল্যাণমুখী কাজ হয়েছে। মানুষ তাঁর জন্য এখনো দোয়া করে। তাঁর আদর্শ অনুসরণ করে, তাঁর দেখানো পথেই চলব।’
জাতীয় পার্টি নিয়ে পারিবারিক বিরোধ সৃষ্টি হতে পারে কি? এমন প্রশ্নের জবাবে জি এম কাদের বলেন, ‘না, তা হবে না। এরশাদ সাহেব কেবল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বা রাষ্ট্রপতিই ছিলেন না, তিনি ছিলেন আমাদের অভিভাবক। পিতার মতো আমাদের আগলে রেখেছেন। স্নেহ-ভালোবাসা দিয়েছেন। ভাবি রওশন এরশাদ আমাদের মায়ের মতো। ভাইয়ের অবর্তমানে তিনি আমাদের অভিভাবক। তাঁর পরামর্শ শিরোধার্য করে চলব।’
জাতীয় পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এরশাদের আদর্শ আমাদের সামনে আছে। তিনি যে সংগঠন গড়ে দিয়ে গেছেন সে সংগঠন আছে। এরশাদের জনপ্রিয়তা আছে। তাঁর প্রতি মানুষের ভালোবাসা আছে। তিনি সব কিছু গুছিয়ে দিয়ে গেছেন। সম্পত্তি ট্রাস্ট করেছেন। রাজনীতির উত্তরাধিকার ঠিক করে গেছেন। আশা করি আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে এরশাদের রেখে যাওয়া সংগঠনটি এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন