বাংলাদেশে বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিদ্যমান, কিন্তু পার্লামেন্টে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উপস্থিতি এতটাই বেশি যে বাস্তবে কোন ধরনের বিরোধিতা ছাড়াই তারা কাজ করছে।
২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বড় ধরনের জয় পেয়েছে। নির্বাচনের মান নিয়ে কিছু মানুষ কি ভাবলো তাতে কিছু যায় আসে না। আসল বিষয় হলো নির্বাচনের ফল, আর সেখানে দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগই রয়েছে সবখানে।
আওয়ামী লীগ খুশি, তাদের খুশি হওয়ারই কথা। কিন্তু যখন এক দলের প্রাধান্য এতটা বেশি থাকে, তখন এর সাথে সুনির্দিষ্ট কিছু সমস্যা থাকে। তাদের ‘জনপ্রিয়তা’ তখন অভ্যন্তরীণ সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
এর আরেকটা অর্থ হলো অনেকের কাছে তখন কমন সেন্সের বিষয় হয় এই দলে যোগ দেয়াটা, কারণ এই দলটাই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ। সবাই দলের সদস্য হতে চায়। দলের ছাত্র শাখার কমিটি গঠন নিয়ে সম্প্রতি যে ঘটনা ঘটেছে, ঘটনা হিসেবে এটা অত বড় না হলেও এতে ধারণা পাওয়া যায় যে পরে কি আসতে যাচ্ছে। আমরা যেটা দেখবো, সেটা হলো একদলের প্রাধান্য কেন্দ্রিক রাজনৈতিক ইস্যু।
৩০১ সদস্যের কমিটি যথেষ্ট বড় নয়?
চলতি সপ্তাহে ছাত্রলীগের কমিটির সদস্যপদ চূড়ান্ত করার আগে কয়েক মাস ধরে ‘কমিটিতে রাখা বা বাদ দেয়ার’ ইস্যুটি চলে আসছে। তবে, দলের প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩০১ সদস্যের যে কমিটি অনুমোদন দিয়েছেন, সেখান থেকে বাদ পড়ারা এতে অখুশি হয়েছে। বাদ পড়ারা বিক্ষোভ করলে সেখানে বাধা দেয় কমিটিতে থাকা সদস্যরা।
এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে মারামারি হয় এবং এতে ১০ থেকে ১৫ জন আহত হয়। এদের সবাই বাদ পড়া গ্রুপের। কয়েকজনকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। সঙ্ঘাত এখনও চলছে।
এদিকে, সোশাল মিডিয়ার কল্যাণে পুরো ঘটনা প্রকাশিত হয়ে গেছে। জনগণের বিনোদনের পাশাপাশি কমিটির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বিষয়টি এখানে প্রকাশিত হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ বিরোধী পক্ষগুলো স্বাভাবিকভাবে অন্যদের চেয়ে এটা বেশি করতে চেয়েছে। বাদ পড়াদের কিছু অভিযোগ যথেষ্ট কুৎসিত ও যৌন বিষয়ক।
বেশ কয়েকজন ছাত্রনেতা বলেছেন যে, যাদেরকে কমিটিতে রাখা হয়েছে, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বিবাহিত, কেউ ব্যবসায়ী, কিছু মাদকাসক্ত এবং এমনকি মাদক পাচারকারীও রয়েছেন। সদস্য লাবনীর ছবি দেখে মনে হয় যেন তিনি বলতে চাচ্ছেন যে, বিবাহিত হওয়ার কারণে ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ পদবী হারালেও কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন তিনি! তবে, প্রকৃত বিষয় হলো তিনি তালাকপ্রাপ্তা এবং এখন একাকি আছেন।
সোশাল মিডিয়ায় যে ছবিটি ভাইরাল হয়েছে, সেটা হলো শ্রাবণী শায়লার রক্তাক্ত মুখের ছবি। এক বছর আগে তার ছবি আরেকবার ভাইরাল হয়েছিল যেখানে সে ক্ষমতাসীন দলের বিরোধী পক্ষের এক নারী অ্যাক্টিভিস্টকে পেটাচ্ছিল। তবে হতে পারে যে এটা সে নয়, আরেক দলীয় কর্মী শ্রাবণী দাস, তবে শায়লাও এই মারামারিতে আহত হয়েছে।
বহুদলীয় ব্যবস্থায় এক দলের আধিপত্য?
এদিকে, নতুন কমিটি তদন্তের ঘোষণা দিয়েছে এবং ৪৮ ঘন্টার মধ্যে রিপোর্ট দাখিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বাদ পড়ারাও আলটিমেটাম দিয়ে বলেছে যে, সমস্যার সমাধান না হলে তারা ব্যবস্থা নেবে।
আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হানিফ বলেছেন যে, এটা ছোটখাটো বিষয় এবং শিগগিরই এর সমাধান হয়ে যাবে। সন্দেহ নেই কথাটা সত্য। তবে যেটা নিশ্চিত, সেটা হলো নতুন একটা রাজনৈতিক কাঠামোর আবির্ভাব হচ্ছে, সেটা হলো বহুদলীয় সিস্টেমে এক দলের আধিপত্য।
১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ সংবিধান পরিবর্তন করে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল কিন্তু সেটা স্থায়ী হয়নি কারণ বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয় এবং সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন থেকেই, বহু বেসামরিক ও সামরিক সরকার দেশ শাসন করেছে। কিন্তু এটা নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিপক্ক হয়েছে।
রাজনীতিবিদরা রয়েছে সবার নিচে
আরেকটি সমস্যা হলো রাজনীতিবিদরা আর ক্ষমতাসীন শ্রেণীর চার স্তরের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাধর নয়। সবার উপরে রয়েছে সশস্ত্র বাহিনী, ব্যবসায়ী গ্রুপ, এবং আমলারা। রাজনীতিবিদরা সবার পরে।
কিছু শ্রেণী একে অন্যের সাথে মিশে গেছে, যেমন অনেক ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদও রয়েছে, অনেক আমলা রাজনৈতিক অনুগত হিসেবে সিভিল সার্ভিসের কাজ করছেন, প্রাতিষ্ঠানিক বিভেদটা সেখানেই তৈরি হচ্ছে।
বেসামরিক ও সামরিক আমলারা ব্যবস্থাপনার জায়গায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে যেখানে ব্যবসায়ীরা হলো পুরো সিস্টেমের অর্থ যোগানদাতা। এই সব গ্রপগুলোই নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ, শুধুমাত্র রাজনীতিবিদ সরবরাহের জায়গাটাই সীমাহীনভাবে উন্মুক্ত।
ক্ষমতাসীন শ্রেণী হয়তো শেষ স্তরের সদস্য সংখ্যা আর বাড়াতে আগ্রহী নয়। অ্যাক্টিভিস্ট শিক্ষার্থীদের একটা অংশ অবশ্য সরকারী চাকরিজীবী হবে, কিন্তু অন্যান্য পথ খোলা না থাকায় আরও অনেককে রাজনীতির সাথে লেগে থাকতে হবে। আর তার অর্থ হলো রাজনীতিবিদ হওয়ার অর্থ হলো আওয়ামী লীগের সদস্য হতে ইচ্ছুক বাকি বহু মিলিয়ন মানুষের সাথে তার প্রতিযোগিতায় নামা, কারণ ক্ষমতাসীন শ্রেণীর মধ্যে কেবল এই স্তরটাই উন্মুক্ত আছে।
ক্ষমতাসীন শ্রেণীর রাজনীতিবিদদের সমস্যা
রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকতে হলো দক্ষতার দরকার যেটা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর রয়েছে। তিনি প্রতিকূলতার মধ্যে সক্রিয় থেকে টিকে আছেন। কিন্তু নতুনদের মধ্যে অনেকেরই সেই যোগ্যতা নেই।
তরুণ যে ক্যাডাররা ক্যাম্পাসে কে জায়গা পেলো আর কে বাদ পড়লো, তা নিয়ে যুদ্ধ করছে, তাদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা খুবই সামান্য বা একেবারেই নেই। ক্যাম্পাসে শুধুমাত্র এক ধরনের তৎপরতা থাকে, তাই তারা শিখে সামান্য কিন্তু আশা করে বেশি। তাই কমিটিতে জায়গা পাওয়ার প্রত্যাশাটা তাদের অনেক বেশি।
বহুদলীয় ব্যবস্থায় এক দলের আধিপত্য যত বাড়বে, ততো ওই দলে যোগ দিতে চাইবে ক্যাডাররা। বেশি মানুষকে জায়গা দিয়ে, ক্ষমতা কাঠামোয় সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে দলের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যায় এবং সবাইকে খুশি রাখা যায়। কিন্তু এটা বলা সহজ হলেও করা কঠিন।
ক্ষমতাসীন শ্রেণীর সুবিধাভোগী সদস্যপদ নিশ্চিত করার অর্থ হলো অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতাটা আরও প্রবল হবে। আগামীতে কি অপেক্ষা করছে, ছাত্রদের কমিটিটা সেটার একটা আগাম ইঙ্গিত মাত্র।
আফসান চৌধুরী।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন