দুর্নীতি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে কারান্তরীণ থাকা চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তি পাচ্ছেন- এমন সম্ভাবনা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল কয়েকদিন আগে। বিএনপির ৬ নির্বাচিত সদস্যের সংসদে যোগদানের শর্তে খালেদা জিয়ার প্যারোল নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির সমঝোতার চেষ্টা চলছিল- এমন খবরই নিশ্চিত করেছিল বিভিন্ন সূত্র। তবে শেষ পর্যন্ত সে সমঝোতা ভেস্তে গেছে। খালেদা জিয়ার আর প্যারোল হচ্ছে না, উন্নত চিকিৎসার জন্য তার আর বিদেশেও যাওয়া হচ্ছে না। তবে আগের মতোই আইনি লড়াইয়ের মধ্যদিয়ে খালেদার জামিনের জন্য বিএনপিকে লড়তে হবে আদালতে।
তবে খালেদা জিয়া প্যারোলের আবেদন করবেন না- এমনটা অনেক আগেই বলা হচ্ছিল বিএনপির তরফ থেকে। যদিও বিএনপির শীর্ষনেতাদের নানা বক্তব্যে লুকিয়ে ছিল রহস্য। ‘মুক্ত পরিবেশে খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা’ দাবি করেছেন কয়েকজন শীর্ষনেতা। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর খালেদার প্যারোলের সিদ্ধান্ত একান্তই তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বলেও উল্লেখ করেছেন।
বিএনপির বিশ্বস্ত কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচিত সদস্যদের সংসদে যোগদানের ডেডলাইন ৩০ এপ্রিলের আগেই খালেদার প্যারোলের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসতে পারে এবং এ নিয়ে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তাদের দরকষাকষি চলছিল। বিশেষ করে আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদার মুক্তি যখন দীর্ঘসূত্রতায় আটকে গেছে তখন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত-সমঝোতার পথেই বিএনপি তার মুক্তির পথ খুঁজছিল বলে জানায় বিএনপির সূত্রগুলো।
তাদের মতে, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে কারান্তরীণ খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ। তার চিকিৎসা প্রয়োজন। প্যারোলে মুক্ত হলে তার ইচ্ছা অনুযায়ী তিনি চিকিৎসা নিতে পারবেন। কিন্তু এখন তার আর প্যারোলের কোনো সম্ভাবনা নেই। গতকাল বিএনপি থেকে নির্বাচিত জাহিদুর রহমান সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেওয়ার পর প্যারোল নিয়ে আলোচনা-সমঝোতার সব ধরনের সম্ভাবনাই উবে গেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। এখন যথারীতি আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং অন্তর্বর্তীকালীন জামিনের জন্য লড়ে যাওয়া ছাড়া বিএনপির আর কোনো পথ খোলা থাকল না।
বিএনপি সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রায় তিন দশকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে খালেদা জিয়া কখনো কারো সঙ্গে আপস করেননি। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও গণতন্ত্রের স্বার্থে তিনি কোথাও কোনো ছাড় দেননি। এরশাদের নানা প্রলোভনেও অটল থেকেছিলেন রাজপথে। সর্বশেষ এক/এগারোর সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়েও কোনো ধরনের আপসরফার কথা ভাবেননি। এমনকি বিদেশে চিকিৎসার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে কারান্তরীণ থেকে দেশেই অবস্থান করেছেন।
গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি কারারুদ্ধ হওয়ার পর থেকে বিএনপি দুর্যোগপূর্ণ সময় অতিক্রম করছে। তার কারান্তরীণ অবস্থাতেই দেশের একাদশ জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। সে নির্বাচনে ৩শ আসনে মাত্র ৬ জন প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন দল থেকে। অবস্থাদৃষ্টে বিএনপির এত কম সংখ্যক আসন পাওয়াকে ‘শোচনীয় পরাজয়’ বলে মনে করা হলেও বিএনপি মনে করে, চাতুরিপূর্ণ ও ভোট ডাকাতির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মূলত বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করার কৌশল নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এমন সময়ে বিএনপি চেয়ারপারসনকে প্যারোলে মুক্তির কথা বলে চিকিৎসার নামে তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছিল। কিন্তু সে ফাঁদে পা দেননি খালেদা জিয়া। উপরন্তু বিএনপি প্রথম থেকেই বলে আসছিল, প্যারোল নয় খালেদার মুক্তি ও সুচিকিৎসাই বিএনপির দাবি।
খালেদা জিয়ার আইনজীবীরাও বলেছেন, সরকার হস্তক্ষেপ না করলে খালেদা জিয়া স্বাভাবিকভাবেই জামিন পান। কিন্তু তার জামিন প্রলম্বিত করা হচ্ছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভীসহ অন্যান্য শীর্ষনেতার সাম্প্রতিক বিভিন্ন বক্তৃতা বিবৃতিতেই এমন ভাষ্য উঠে আসে।
এর মধ্যে অবশ্য প্যারোল নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে ধোঁয়াশাপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। গত ৩১ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট বার ভবনে সাংবাদিকদের সামনে বিএনপি চেয়ারপারসনের আইনজীবী ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন খালেদা প্যারোলে মুক্তি পেতে পারেন বলে বক্তব্য দেওয়ার পর মূলত প্যারোল নিয়ে গুঞ্জনের সূত্রপাত। কারণ তার বক্তব্যের পরপরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছিলেন, সুনির্দিষ্ট কারণ দেখিয়ে খালেদা জিয়া প্যারোলের আবেদন করলে তা সরকার খতিয়ে দেখবে। খন্দকার মাহবুবও তার বক্তব্যে বলেছেন প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয় মাত্র। ফলে এর মধ্যে সরকারি দল ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতার ইঙ্গিত খুঁজেছেন অনেকে। খন্দকার মাহবুব হোসেন গত বছরও খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি চেয়েছিলেন।
এবার যখন তিনি প্যারোলের কথা তুললেন, তখন সংসদে নির্বাচিত সদস্যদের শপথ নেওয়ার সময় শেষ হয়ে আসছিল। চারদিকে এমন প্রশ্ন চাড়া দিয়ে উঠছিল যে-বিএনপি কি শেষতক সংসদে যাওয়ার পথ খুঁজছে? সে জন্য কি কোনো ধরনের আপসরফার দিকে এগোচ্ছে দলটি? কারণ এরই মধ্যে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দুই নির্বাচিত সংসদ সদস্য গণফোরামের সুলতান মনসুর ও মোকাব্বির খান সংসদে যোগদান করেছেন।
নির্বাচনের ফল বর্জন করেও এ দুই নেতার সংসদে যোগদান রাজনীতির নানা হিসাব-নিকাশ প্রায় ওলটপালট করে দেয়। এর মধ্যে বিএনপির ৬ সংসদ সদস্যও জরুরি বৈঠকে বসে সংসদে যোগ দেওয়া না দেওয়া নিয়ে আলাপ করেছেন। সেখানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়া বাকি সবাই সংসদে যোগদানের ব্যাপারে মতো দিয়েছেন বলে জানা যায়। যদিও বিএনপি সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা এ সংসদে যোগদান করবে না। সংসদে যোগদানের ডেডলাইন ৩০ এপ্রিল যত ঘনিয়ে আসছে বিএনপি ৬ সদস্যের ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ তত বাড়ছে। তবে সর্বশেষ কী ঘটে তা দেখার জন্য ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে রাজনীতির অনুসন্ধিৎসু পর্যবেক্ষকদের। বিধি অনুযায়ী সংসদ গঠনের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচিত সদস্যদের শপথ নিতে হয়। যদিও স্পিকার চাইলে সদস্যদের আবেদনের প্রেক্ষিতে এ সময় বাড়াতে পারেন।
গতকাল ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের সংসদ সদস্য জাহিদুর রহমান দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে শপথ নেওয়ার পর বিএনপি নেতারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে যারা সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছেন বা নেবেন, তারা ‘গণদুশমন’ হিসেবে চিহ্নিত হবেন। তিনি বলেন, খালেদা জিয়াকে জেলখানায় রেখে কেউ যদি শপথ নিয়ে থাকে এবং ভবিষ্যতে নেয়, তারা জাতীয়তাবাদী শক্তির সঙ্গে চলার যোগ্যতা রাখে না।
সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সংসদে শপথ নেওয়ায় দল থেকে বহিষ্কার হতে পারেন জেনেও সংসদে থাকার পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন জাহিদুর রহমান। তিনি বলেছেন, দল আমাকে বহিষ্কার করতে পারে জেনেও আমি শপথ নিয়েছি। দল বহিষ্কার করলেও আমি দলে আছি। তিনি জানান, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে সংসদে যে ভূমিকা রাখা দরকার তিনি তা রাখবেন। সংসদে গিয়ে তিনি খালেদা জিয়ার মুক্তি চাইবেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন