আসছে বাজেট তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম বাজেট। রাজনীতি ও অর্থনীতিকে সমান গুরুত্ব দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে নতুন বাজেট। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নির্বাচনী ইশতেহার আর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আয়-ব্যয় তথা প্রবৃদ্ধির সুষম বণ্টনে বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটের আকার কিছুটা বাড়িয়ে পাঁচ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা প্রাক্কলন করা হয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুমোদন দেওয়ার আগে এ আকারেও পরিবর্তন আসতে পারে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের প্রথম বাজেটে রাজস্ব আয় ধরা হচ্ছে ইতিহাস সৃষ্টিকারী, তিন লাখ ৭২ হাজার কোটি টাকা। আয়-ব্যয়ের বিশাল লক্ষ্যমাত্রায় ঘাটতিও হবে এযাবৎকালের সবচেয়ে বড়, দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি। গতকাল বুধবার অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সভায় উপস্থিত একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে সভায় উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদার, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
পরে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাজেটের একটি রূপরেখা হয়েছে মাত্র। চূড়ান্ত কিছু হয়নি। প্রধানমন্ত্রী এটি অনুমোদন দেননি। তাই কিছু বলব না।’ রাজস্ব সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘রাজস্ব আদায় বাড়বে। তবে আগামী অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা সম্পর্কে কিছু বলব না।’
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে অর্থমন্ত্রী প্রথমেই চলতি অর্থবছরের বাজেট নিয়ে কথা বলেন। বিশেষ করে রাজস্ব খাত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি। কারণ গত সাত মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) গ্রোথ রেট ৭.১ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ১৫.৬৪ শতাংশ। জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি যোগ করে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরে এনবিআরের প্রকৃত প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক; যা বাজেটের আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এতে ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে আশঙ্কাজনকভাবে। ওই সময় এনবিআর কর্মকর্তাদের কাছে ইসিআর মেশিন কেনার সর্বশেষ অবস্থা জানতে চান মন্ত্রী। এ বিষয়ে এনবিআরকে আরো সক্রিয় হতে বলেন তিনি। এরপর শুরু হয় আগামী অর্থবছরের বাজেট আলোচনা। সভায় বলা হয়, নতুন বাজেটের মূল দর্শন হবে প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানবান্ধব। সাধারণ মানুষ যাতে বুঝতে পারে সে জন্য বাজেট হবে সাবলীল ও সংক্ষিপ্ত।
সূত্র মতে, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের জন্য প্রাথমিকভাবে বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে পাঁচ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। এটি চলতি অর্থবছরের বাজেট থেকে ৬০ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা বা ১৩ শতাংশ বেশি। সর্ববৃহৎ এ বাজেটের চাপ মেটাতে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে তিন লাখ ৭২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের প্রাক্কলিত আয় তিন লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআরবহির্ভূত আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকা। কর ব্যতীত রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৩৮ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে দেশের মাত্র ১১ শতাংশ মানুষ আয়কর দেয়। আর সামগ্রিকভাবে ১৪ শতাংশ মানুষ সরকারকে নানাভাবে রাজস্ব দেয়। এই হার কমপক্ষে ২০ শতাংশ হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করে সরকার। এ জন্য বৈঠকে আগামী পাঁচ বছরের একটি কর্মপরিকল্পনা ঠিক করা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, নতুন বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার প্রাথমিকভাবে প্রস্তাব করা হয়েছে এক লাখ ৯৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এটি মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) ৬.৮ শতাংশ। এ ছাড়া আগামী অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে এক লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি আছে এক লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪.৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের প্রাক্কলিত বাজেট ঘাটতি ২৭ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা বেশি। আসন্ন বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৮.২ শতাংশ। চলতি অর্থবছর শেষে ৮.১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে আশা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছিল ৭.৮ শতাংশ। আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৫.৫ শতাংশে আটকে রাখার চেষ্টা থাকবে।
সূত্র মতে, আসছে বাজেটে সবচেয়ে বড় চমক থাকবে তিন স্তরের ভ্যাট ঘোষণা। ভ্যাটের হার হবে ৫, ৭ ও ১০ শতাংশ। ১ জুলাই নতুন ভ্যাট আইনের আংশিক কার্যকর করা হবে। এ ছাড়া করপোরেট কর কমানো, কৃষকদের জন্য শস্য বীমা চালু, সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতা বাড়ানোর ক্ষেত্রেও চমক থাকবে। বিশেষ করে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় প্রতি পরিবার থেকে চাকরির বিষয়টি এরই মধ্যে সাড়া ফেলেছে। নির্বাচনী ইশতেহারে থাকা এ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছায়।
জানা যায়, আগামী বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে সরকার তুলনামূলকভাবে কম ঋণ নেবে, যা বেসরকারি বিনিয়োগে গতির সঞ্চার করবে। বৈঠকে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিও জোর দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে চলমান মেগাপ্রকল্পগুলোর কাজ সময়মতো শেষ করতে পারলে কর্মসংস্থান বাড়বে বলে মত দেওয়া হয়। এ ছাড়া নির্বাচনী অঙ্গীকার সামনে রেখে বাজেটে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে গ্রামীণ জনপদের উন্নয়নকে। গ্রামেই যেন মানুষের কর্মসংস্থান হয় সে ধরনের প্রকল্প নেওয়া হবে। পাশাপাশি কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ, রপ্তানি খাতকেও অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে সভায়। বিশেষ করে খেলাপি ঋণ, প্রবাসী আয়ে নেতিবাচক প্রভাব, বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য, বেসরকারি বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা হয়। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট অনুমোদন দেওয়া হয়। সংশোধিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে চার লাখ ৪৬ হাজার টাকা। চলতি বাজেটে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা দুই লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। সেটি কাটছাঁট করে দুই লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকায় আনা হয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন