একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের নির্বাচিত ৬ এমপির শপথ না নেয়ার সিদ্ধান্তে এখনও অটল রয়েছে বিএনপি। তবে, শপথ গ্রহণের বিষয়ে দলের নেতিবাচক সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ বিএনপি থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা।
বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্যদের অধিকাংশের বক্তব্য, দল এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে একবারও তাদের সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন মনে করেনি। এক্ষেত্রে নির্বাচিতদের কোনো মূল্যায়নই করেনি। এরপরও দলের সিনিয়র নেতারা বিভিন্ন কর্মসূচিতে যে ধরনের বক্তব্য দিয়ে আসছেন তা নিতান্তই এসব নির্বাচিত এমপিদের জন্য মানহানিকর ও অপমানজনকও বটে !
নির্বাচিতদের বক্তব্য হচ্ছে, ‘সংসদে যাওয়া না যাওয়ার মতো এত বড় সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বিএনপির উচিত ছিল অন্তত নির্বাচিতদের সঙ্গে বসে আলোচনা করা। তাদের একটু সান্ত্বনা দেয়া। একটু সম্মান দেয়া। এসব তো করেইনি, বরং বিভিন্ন নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে যেসব হেভিওয়েট নেতারা নির্বাচিত হতে পারেননি তারা বলে বেড়ান যে, সরকার আমাদের নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে বিজয়ী করেছে! নৌকাকে হারিয়ে আমাদের নাকি আওয়ামী লীগ বিজয়ী করে এনেছে! এমনিতে সংসদে যাওয়া না-যাওয়া নিয়ে আমরা জ্বালায় আছি, অপরদিকে দলের এসব সিদ্ধান্ত ও বক্তব্যে আমরা রীতিমত ক্ষুব্ধ, হতাশ।‘
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, সংসদে না যাওয়ার বিষয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিএনপি থেকে নির্বাচিতদের মধ্যে একাধিক ব্যক্তি সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিতে পারেন বলে আশঙ্কা করছে বিএনপি। তবে শপথ গ্রহণের বিষয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত নেতিবাচক হওয়ায় নির্বাচিতরা বলছেন, ‘বিষয়টি নিয়ে তারা অশান্তি ও জ্বালায় রয়েছেন।’
গত সোমবার রাতে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় এমপিদের শপথ না নেয়ার। বৈঠকে লন্ডন থেকে স্কাইপে যুক্ত ছিলেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
তবে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নির্বাচিত এমপিদের ‘সংসদে যাওয়া না-যাওয়ার’ বিষয়ে কোনো কথাই হয়নি বলে জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
তিনি বলেন, বিএনপি সংসদে যাবে না- এই সিদ্ধান্ত তো আগেই নেয়া আছে। আমাদের সেই সিদ্ধান্তের কোনো পরিবর্তন হয়নি। আগের সিদ্ধান্তই বহাল আছে। তবে কথা উঠেছিল যে, কোনো কোনো এমপি ব্যক্তিগতভাবে কিছু মন্তব্য করছেন। সেটা করা উচিৎ না।
সম্প্রতি হয়ে যাওয়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবির মধ্যেও ৬টি আসনে বিএনপির প্রার্থীরা জয়ী হন। তাদের মধ্যে ঠাকুরগাঁও-৩ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছেন জাহিদুর রহমান, বগুড়া-৪ আসন থেকে মোশারফ হোসেন, বগুড়া-৬ আসন থেকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসন থেকে আমিনুল ইসলাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসন থেকে হারুনুর রশিদ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসন থেকে উকিল আব্দুস সাত্তার ভূইয়া নির্বাচিত হয়েছেন।
এই নির্বাচিত ৬ জনের মধ্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপির মহাসচিব। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ থেকে নির্বাচিত হারুনুর রশিদ যুগ্ম মহাসচিব। বাকিদের মধ্যে উকিল আব্দুস সাত্তার বিএনপির বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা। বিগত সময়েও জোটের কারণে তাকে একাধিকবার বিএনপির মনোনয়ন দেয়া না হলেও তিনি দল ছাড়েননি বা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাননি। এবারও দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে না যাওয়ার ওয়াদা করেছেন দলটির সিনিয়র এই নেতা। এর বাইরে বাকি তিন জনের মধ্যে অন্তত দুজন শেষ মুহূর্তে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিতে পারেন বলে বিএনপিতে গুঞ্জন চলছে।
বিএনপি থেকে নির্বাচিত এক সংসদ সদস্য দৈনিক জাগরণকে বলেন, দল আমাদের ন্যূনতম মূল্যায়নই করছে না। তারা যে সিদ্ধান্ত নেবে, আমরা জিতলাম, আমাদের ডাকলে তাদের অসুবিধা কি ওনাদের? তারা বলতে পারতেন, আসুন আমরা আপনাদের কথা শুনি। তিনি বলেন, আপনার বাড়ি ডাকাতি হচ্ছে-সেখানে কেউ সাহসিকতার সঙ্গে পাহারা দিয়ে আপনার ধন-সম্পদ রক্ষা করে ফেললো। অন্তত পক্ষে সেই লোককে সবার সামনে ডেকে একটু ধন্যবাদ দিলে সে আরও অনুপ্রাণিত হত, বেশি উৎসাহী হত। কেন যে তারা করে না, আল্লাহই জানেন।
তিনি বলেন, খালি বলে- ম্যাডামের মুক্তি চাই। কোথায় মুক্তি চায়? প্রেসক্লাবে? প্রেসক্লাবে মুক্তি চাই বলে ৫ বছর কাঁদলেও ম্যাডামের মুক্তি হবে না। মুক্তি আনতে হলে যা করার দরকার, তাই করতে হবে।
বিএনপি দলীয় ওই সংসদ সদস্য আরও বলেন, তবে ঠিক আছে, আমরা এখনও দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে নই। দল কী বলে এখনও ফাইনালি আমাদের জানানো হয়নি। আসলে নির্বাচিত হয়েই আমরা ভুল করেছি। আমার/আমাদের এলাকার জনগণও ভুল করেছে। এরা আবার ট্রিট করে যে ৫/৬টি আসন ছেড়ে দিয়েছে সরকার। আরে ছেড়ে দিয়েছে মানে? সরকারের অনুগ্রহ নিয়ে কি আমরা পাস করেছি। নিজের ক্ষমতা দেখিয়ে, নিজের এলাকায় যুদ্ধ করে পাস করেছি।
জানা গেছে, ঠাকুরগাঁও-৩ আসন থেকে নির্বাচিত জাহিদুর রহমান ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসন থেকে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচিত আমিনুল ইসলাম শেষ মুহূর্তে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিতে পারেন বলে বিএনপিতে একটি গুঞ্জন চলছে।
এ বিষয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসন থেকে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচিত আমিনুল ইসলাম দৈনিক জাগরণকে বলেন, আমি আপাতত ওই সিদ্ধান্তেই আছি। আমি পার্সোনালি কোনো সিদ্ধান্ত এখনও নেইনি। দেখা যাক দল কী বলে !
সেক্ষেত্রে যদি দল শপথ গ্রহণ না করার সিদ্ধান্তে অটল থাকে তাহলে আপনার সিদ্ধান্ত কী- জানতে চাইলে আমিনুল ইসলাম বলেন, আমি এখনও সিদ্ধান্ত নেইনি। সময়ও শেষ হয়ে আসছে ! মন মেজাজ খুব একটা ভাল নেই ভাই। নানা রকম অশান্তির মধ্যে আছিরে ভাই। দোয়া করবেন। দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কী হয়...।
ঠাকুরগাঁও-৩ আসন থেকে নির্বাচিত জাহিদুর রহমান জানান, শপথ নিয়ে সংসদে যাওয়ার ব্যাপারে তার ওপর এলাকার মানুষের চাপ আছে। এ বিষয়ে তিনি মহাসচিবসহ অন্য নেতাদের অবহিত করেছেন। সংসদে যাওয়ার ব্যাপারে তার নিজেরও আগ্রহ আছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে জ্বালায় আছি। মাত্র আর কয়েকদিন সময় আছে। সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে দল অটল থাকলে আমরা বসে আলোচনা করে একটি সিদ্ধান্ত নেব।
বগুড়া-৪ আসন থেকে নির্বাচিত মোশাররফ হোসেন দৈনিক জাগরণকে বলেন, ‘স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়েছে, সেখানে অন্তত আমাদের যারা জিতেছি তাদের ডাকত। ডাইকা আমাদের বলত যে, বাবা তোমরা জিতেছো, তোমাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ। তবে আমাদের দলীয় সিদ্ধান্ত এই, দলের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত এই। তো তোমরা জিতেছো, তোমাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমরা এই সময় আপাতত তোমাদের সংসদে নিতে পারছি না। ইনশাল্লাহ আগামীতে তোমাদের সবাইকে ভালো ভালো জায়গায় মূল্যায়ন করা হবে। আপাতত দলের জন্য এটা আমরা স্যাক্রিফাইস করতে পারি। দ্যাটস এনাফ !
স্থায়ী কমিটির এক সদস্য দৈনিক জাগরণকে জানান, বৈঠকে সংসদ সদস্য হিসেবে দলের নির্বাচিতদের এমপি হিসেবে শপথ নেয়া না-নেয়ার বিষয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মতামত শোনেন লন্ডন থেকে স্কাইপে যুক্ত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেখানে সদস্যগণ নিজেদের মতামত তুলে ধরেন। সবার মতামত শোনার পর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও নিজের সিদ্ধান্ত দেন। একইসঙ্গে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে কেউ শপথ গ্রহণ করলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতেও নির্দেশনা দেন।
তিনি জানান, তারেক রহমান স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মতামত জানার পর সিদ্ধান্ত দিয়েছেন বিএনপি থেকে নির্বাচিত কেউ শপথ নেবেন না। যেহেতু ৩০ এপ্রিল তাদের শপথ নেয়ার শেষ সময় সেজন্য চলতি সপ্তাহের যেকোনো দিন নির্বাচিত ৬ এমপিকে গুলশান কার্যালয়ে ডেকে দলের এ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হবে। কেউ সিদ্ধান্ত অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে দলীয় ফোরামে এ পর্যন্ত যত বৈঠক হয়েছে সবগুলোতেই শপথ গ্রহণ না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। সোমবারের বৈঠকেও সবাই এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন। এছাড়া, বৈঠকে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্যারোলের বিষয়ে গণমাধ্যমে যে সংবাদ হয়েছে সে বিষয়ে আলোচনা হয়।
দীর্ঘ সময় ধরে চলা ওই বৈঠকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান ও আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে, সারাদেশে সম্প্রতি বৃদ্ধি পাওয়া নারী নির্যাতনের বিভিন্ন ঘটনার প্রতিবাদে দলীয়ভাবে কর্মসূচি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটি। গতরাতের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, দ্রুত সময়ের মধ্যে সংবাদ সম্মেলন করে এ কর্মসূচি ঘোষণা করবে বিএনপি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন