বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি সরকারের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে প্যারোলে নাকি আইনি প্রক্রিয়ায়-এ নিয়ে দলের মধ্যে মতবিরোধের জের এখন দলাদলি পর্যন্ত গড়িয়েছে। এ ইস্যুতে দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকেই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ভুলে ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতি, ক্ষমতা ও প্রভাবের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। বিষয়টি নিয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দুই ধরনের মতের কথাও শোনা যায় দল ও পরিবারের সদস্যদের সূত্রে।
দলটির একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, বিএনপি নেতাদের অনেকেই মনে করেন, যে কোনো উপায়ে খালেদা জিয়ার মুক্তি দরকার। তাদের মধ্যে একটি অংশের মতে, দলে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সমন্বয় নেই। যার কারণে দলের প্রয়োজনে যে কোনো উপায়ে চেয়ারপারসনের বাইরে থাকা দরকার। কেউ কেউ মনে করেন, খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা গুরুত্ব হারিয়েছেন। দলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের মতামত নেওয়া হচ্ছে না, মতামত নেওয়া হলেও তা প্রাধান্য পাচ্ছে না।
ওই অংশটি প্যারোলে হলেও খালেদা জিয়ার মুক্তি চান, যেন দলের সব পর্যায়ে ‘ভারসাম্য’ তৈরি হয়। এর বাইরেও একটি অংশের মতামত সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা মনে করেন, খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তি নিলে তার আপসহীন চরিত্রে ছেদ পড়বে। বিএনপি চেয়ারপারসন ও তার দলের রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটবে। এর চেয়ে বন্দি খালেদা জিয়া-ই অনেক শক্তিশালী। এমন পরিস্থিতির মধ্যে তারেক রহমানের সঙ্গে স্কাইপে আলোচনার সময় ১৭ মার্চ কুমিল্লা উত্তর সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান মুন্সী দলের স্থায়ী কমিটির এক সদস্যকে বিএনপির দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব দেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছেন।
তারেক রহমানকে ওই নেতা বলেন, আপনি বিদেশ আছেন, ম্যাডাম কারাগারে। এ অবস্থায় দেশে ‘শারীরিকভাবে’ উপস্থিত একজনকে দলের দায়িত্ব দেওয়া উচিত। এ বক্তব্য নিয়ে দলে বেশ কৌতূহল ও নানা গুঞ্জনের সৃষ্টি হয়েছে। কেন মুন্সী হঠাৎ ওই নেতার নাম প্রস্তাব করলেন, তাও আবার তারেক রহমানের কাছে? জানা যায়, এ প্রস্তাব দেওয়ার আগের রাতে মুন্সী ওই নেতার সঙ্গে বৈঠকও করেন। অনেক নেতার ধারণা, বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে দলে প্রভাব বিস্তার নিয়ে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক লড়াই চলছে। কেউ ক্ষমতা হারানোর ভয় আবার কেউ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার নানা কৌশলে ব্যস্ত। এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে খালেদা জিয়ার মুক্তিও।
জানতে চাইলে মুন্সী ক্ষুব্ধ হয়ে এই প্রতিবেদকের কাছে জানতে চান সাংবাদিকতার বয়স কত? এ ধরনের প্রশ্ন কেন করা হলো জানতে চাইলে মুন্সী বলেন, এ ধরনের প্রশ্ন করা ঠিক হয়নি। কারণ তার রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতায় তিনি মনে করেন না, কোনো রাজনৈতিক নেতা দলীয় ফোরামে এমন কথা বলতে পারেন। ওই সভায় উপস্থিত জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আক্তারুজ্জামান বিষয়টি অস্বীকার না করে বলেন, মুন্সী কী বলেছেন, সেটি তিনিই ভালো বলতে পারবেন। বিএনপি নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে দলে আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি। অনানুষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন সভায় বিষয়টি উঠেছে। তবে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। কারণ বিষয়টি নিয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য তারা পাননি।
কীভাবে খালেদা জিয়ার মুক্তি চান-জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় আমাদের সময়কে বলেন, খালেদা জিয়া আইনি প্রক্রিয়ায় জামিন পাওয়ার অধিকার রাখেন। এ ধরনের দৃষ্টান্ত সম্প্রতি আছে। সরকারের অনুকম্পায় খালেদা জিয়ার মুক্তি নেওয়া সম্মানজনক হবে না। নেতাদের মধ্যে মতপার্থক্যের ব্যাপারে দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু আমাদের সময়কে বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে দলে অনেক মত আছে। কিন্তু মতের অমিল নেই।
তিনি আরও বলেন, খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে অন্যায়ভাবে কারাবন্দি করে রাখা হয়েছে। তাকে মুক্তি দেওয়ার একমাত্র পথ জামিন। সরকার বিভিন্নভাবে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার জামিন ও মুক্তি প্রক্রিয়াকে প্রলম্বিত করছে। অথচ দুর্নীতির মামলায় ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা সাত বছর সাজা পেয়েও জামিনে ছিলেন। হাইকোর্টে বিচারাধীন থাকাবস্থায়ও জামিন পান।
পরে সাজার মেয়াদ কমলে আপিল বিভাগ থেকে জামিন নেন। তা হলে তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও দলের জনপ্রিয় নেত্রী খালেদা জিয়ার জামিন হবে না কেন? এতে বোঝা যায়, সরকার রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তাকে আটকে রেখেছে। খালেদা জিয়ার পরিবারের একটি সূত্র বলছে, তারেক রহমান প্যারোলে মুক্তি এবং এর জন্য যে কোনো শর্তে রাজি আছেন।
এর কারণ হিসেবে সূত্রটি বলছে, চিকিৎসাধীন মায়ের শারীরিক অবস্থা নিয়ে চিন্তিত তিনি। যার কারণে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে মায়ের জীবন বাঁচাতে হয়তো আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন তারেক রহমান। আবার দলের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, তাদের সঙ্গে আলোচনায় তারেক রহমান প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি একেবারে নাকচ করে দিয়েছেন।
নেতাদের যুক্তি, মায়ের প্রতি আবেগপ্রবণ থাকলেও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে তারেক রহমান সঠিক পথেই আছেন। বাংলা নববর্ষের সময় বিএনপি নেতারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বেগম জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে যান। ওই সময় খালেদা জিয়ার সঙ্গে প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি আলোচনায় আসে। এ ব্যাপারে এক নেতা বলেন, বেগম জিয়া বলেছেন-শুধু প্যারোলে মুক্তি নিলেই হবে না, মান সম্মানের কথাও ভাবতে হবে। সংসদে যোগদান প্রশ্নে বেগম জিয়া বলেন-লাভ কী হবে এতে?
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন