নারায়ণগঞ্জের দুই প্রভাবশালী রাজনীতিক শামীম ওসমান ও সেলিনা হায়াৎ আইভীর দ্বন্দ্ব আবারও প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র। আওয়ামী লীগের এ দুই নেতার পুরনো দ্বন্দ্ব আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এক পক্ষ আরেকপক্ষের বিরুদ্ধে নগ্ন ও প্রকাশ্য আক্রমণ শুরু করেছে। উভয়পক্ষের অনুগত কর্মীদের অশ্লীল আক্রমণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়েছে। এতে শুধু আওয়ামী লীগই নয়, বিব্রত সাধারণ মানুষও। সম্প্রতি আলোচিত কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যার বার্ষিকীতে দেশের বিশিষ্টজনরা নারায়ণগঞ্জে এসে সরকার ও শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে নানা বক্তব্য দেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে শামীম ওসমানপন্থি আওয়ামী লীগ নেতারা আইভীর বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দিয়ে নালিশ জানান। নতুন করে শুরু হয় প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব।
যদিও শামীম ওসমান বরাবর বলে আসছেন, সেলিনা হায়াৎ আইভী বিএনপি-জামায়াতে সঙ্গে গোপনে সখ্যতা রেখে চলেছেন। অন্যদিকে আইভীর দাবি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গেলেই ওসমান পরিবার থেকে প্রথম প্রতিক্রিয়া আসে।
আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি, মূলত কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যা নিয়ে এ দুই নেতার বিরোধ শুরু। এরপর হকার ইস্যুসহ নানা উপলক্ষে এ বিরোধের ডালপালা ছড়িয়েছে। এমনকি টেলিভিশনের একটি টকশোতে দুজন মারমুখী হয়ে ওঠেন। পরে আয়োজকদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। যদিও আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, এ দ্বন্দ্ব অনেক পুরনো। শামীম ওসমানের পিতা এ কে এম সামুজ্জোহা ও সেলিনা হায়াৎ আইভীর পিতা আলী আহাম্মদ চুনকার বিরোধেরই ধারাবাহিক রূপ এটি। নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ইস্যুগুলোতে এ দুই নেতার পরস্পরবিরোধী অবস্থান বেশ স্পষ্ট। আলোচিত সাত খুন, যুবলীগ নেতা পারভেজ গুম, ত্বকী হত্যা, হকার ইস্যু এবং নারায়ণগঞ্জে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি নিয়ে উভয়ে বিপরীত মেরুতে থেকে একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদগার শুরু করেন। যা অনুগত কর্মীদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে।
২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের ইতিহাসের ভয়াবহতম সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এ দুপক্ষের লোকজন। সেদিন হকার ইস্যুকে কেন্দ্র করে মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর ওপর আক্রমণ ও গুলি ছোড়ার ঘটনাও ঘটে। কোনোরকমে সে দিন প্রাণে বাঁচেন আইভী।
মেয়র আইভীর বাবা আলী আহাম্মদ চুনকা ও শামীম ওসমানের বাবা একেএম সামছুজ্জোহার মধ্যে নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক মাঠে দ্বন্দ্ব ছিল। ১৯৭২ সালে শহর আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে এ দুই পরিবারের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে রূপ নেয়। ১৯৭৩ সালে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার নির্বাচন নিয়ে ফের তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এরপর থেকে তা আর থামেনি। দীর্ঘদিন পর বিএনপি সরকার আমলে ২০০৩ সালে দেশে ফিরে বৈরি পরিবেশেও নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন সেলিনা হায়াৎ আইভী। আর ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি করা শামীম ওসমান ১৯৯৬ সালে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে এমপি নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে দ্বিতীয়বারের মতো তিনি এমপি হন। এই দুই নেতার মধ্যে অনেক আগে থেকেই রাজনীতির মাঠে দ্বন্দ্ব চলছিল।
২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন নিয়ে আইভী ও শামীমের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে। তাদের পারিবারিক দ্বন্দ্ব আবার নতুন করে জানতে পারে দেশের মানুষ। ওই বছর স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েও আওয়ামী লীগ প্রার্থী শামীম ওসমানকে এক লাখের বেশি ভোটে হারিয়ে সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন আইভী।
আইভী মেয়র হওয়ার পর নারায়ণগঞ্জে আলোচিত ‘ত্বকী হত্যাকাণ্ড’ ও ‘সাত খুন’ নিয়ে শামীমের সঙ্গে আইভীর দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। প্রকাশ্য সভায় একে-অন্যের প্রতি বিষোদগারের পাশাপাশি টেলিভিশন বিতর্কে তাদের মারমুখী ভূমিকায়ও দেখা যায়।
২০১৬ সালের সিটি নির্বাচনে আইভী ও শামীমের দ্বন্দ্ব আবার প্রকাশ্যে আসে। পরে দলীয়প্রধান শেখ হাসিনা তাদের দুজনকে গণভবনে ডেকে পাঠান। ওই নির্বাচনে আইভীকে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। আর শামীমকে মেয়র নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়ে আইভীকে সহায়তা করতে বলা হয়। ওই নির্বাচনে বিএনপিকে বিপুল ভোটে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন আইভী।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন