বিএনপির নেতাকর্মী সমর্থকদের কাছে এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে দলীয় প্রধান খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি। কিন্তু কি প্রক্রিয়ায় মুক্তি মিলতে পারে তা জানা নেই তাদের। কেন্দ্রীয় নেতারা সুকৌশলে রাজনৈতিক বক্তব্যে আন্দোলনের বিষয়টি সামনে আনলেও মূলত আইনি লড়ইয়ের উপরই গুরুত্ব দিচ্ছেন। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা শুধু আন্দোলনের মাধ্যমেই নেত্রী বের করে আনার দাবি করছেন। আর বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা প্যারোলে হলেও নেত্রীকে মুক্ত করার পরামর্শ দিচ্ছেন। দলের এই ত্রিমুখী অবস্থানের মধ্যে নানা মহলে খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে পর্দার আড়ালে আলোচনার শুরু হয়েছে বলেও গুঞ্জন আছে।
বিএনপি সূত্রমতে, খালেদা জিয়ার মুক্তি বিএনপির কাছে এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য নানামুখী কৌশল নিচ্ছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এখনই আন্দোলন করে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে চাপ দিচ্ছে কেন্দ্রকে। কিন্তু আন্দোলন কতটা সফল করার সম্ভব এ বিষয়টি বিবেচনা করে এখনই কঠোর কোনো কর্মসূচিতে যেতে চায়না কেন্দ্রীয় নেতারা। কঠোর আন্দোলনে না যাওয়ার কারণ হিসেবে তৃণমূলকে জানানো হচ্ছে, আন্দোলন হলেই নেতাকর্মীরা গ্রেপ্তার হবেন। কিন্তু কোন ফল বয়ে আনবে না। আর কর্মীদের বের করে আনতে কেন্দ্রীয় নেতাদেরও আরও চাপে পড়তে হবে।
এ বিষয়ে দলের সিনিয়র এক নেতা বলেন, তৃণমূলের নেতাকর্মীদের চাপ এত বেশি যে, তারা নেতাদের বলছেন মাঠের আন্দোলনের
ঝুঁকি তো কর্মীরা নেবেন তাদের কর্মসূচি দিতে সমস্যা কোথায়। কিন্তু কর্মীদের আহত হওয়া, কারাগারে যাওয়া, মুক্ত করা, জামিনের ব্যবস্থা করা, মামলা জড়ানো কর্মীদের পরিবারের খোঁজখবর নেয়া কেন্দ্রীয় নেতাদেরই করতে হয়। এসব দিক বিবেচনা করে বর্তমান প্রতিকূল অবস্থায় শুধু আন্দোলনের কর্মসূচি দিলেই চলবে না, কৌশলে কার্যকরী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এদিকে বিএনপির ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা প্যারোলে হলেও খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন। খালেদা জিয়া মুক্ত হলে দল ঘুরে দাঁড়াতে পারে এজন্য প্যারোলকে আপস হিসেবে নয় রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বিবেচনায় এনে দ্রম্নত খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার কথা বলছেন বুদ্ধিজীবীরা।
বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপার্চায অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমদ বলেন, আন্দোলনের মাধ্যমে এই মুহূর্তে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা সম্ভব না। সীমাহীন কষ্টের মধ্যে এখন খালেদা জিয়া দিন কাটাচ্ছেন। এভাবে আর কিছু দিন থাকলে তার অনেক ক্ষতি হতে পারে। এজন্য প্যারোলে মুক্ত করতে সরকারের কাছে একটি আবেদন করার চিন্তাভবনা করা হচ্ছে।
বুদ্ধিজীবীরা প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি বললেও প্রকাশ্যে এ ব্যাপারে কথা বলতে রাজিনন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। তারা খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে পুরোপুরি কৌশলী অবস্থানে থাকতে চান। আইনি লড়াই ও আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে সরকারকে চাপ দিতে চান।
দলের সিনিয়র এক নেতা বলেন, খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে বিএনপির লক্ষ হলো-আইনি লড়াই জোরদার, রাজপথে আন্দোলন, সরকারের সঙ্গে দেন-দরবার ও প্রভাবশালী বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে কূটনৈতিক পর্যায় থেকে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি। এজন্য সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুই দফা বৈঠকে খালেদা জিয়ার মুক্তির পথ সন্ধানে করণীয় নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। সেখানে নানা প্রস্তাব উঠে আসে। এছাড়া নির্বাচনের পর খালেদা জিয়ার সিনিয়র আইনজীবী প্যানেলের সদস্যরা কয়েক দফা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন। দ্রম্নত কিভাবে দলীয় প্রধানকে মুক্ত করা যায় সেসব বিষয়ে আলোচনা হয় এসব বৈঠকে। বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে চলমান মামলা ও এসব মামলার সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে একটি তালিকা প্রস্তুতের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার আইনজীবী প্যানেলের সদস্যরা।
দলের এই ত্রিমুখী অবস্থানের মাধ্যে রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন হচ্ছে, আন্দোলন নয়, নতুন নির্বাচনের দাবিও নয় বরং বেগম জিয়ার মুক্তির জন্যই দেনদরবার করছে বিএনপি। বিএনপির প্রভাবশালী কয়েকজন নেতা ও জিয়া পরিবারের সদস্যরা কূটনীতিকদের মাধ্যমে ও সরাসরি সরকারে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলছেন। তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমান খালেদা জিয়ার মুক্তি সম্ভব না হলে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে সরকারের একাদিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন এমনও আলোচনা আছে। শর্তসাপেক্ষে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে দুই পক্ষর মধ্যে কথা চলছে বলেও নানা মহলের আলোচনা হচ্ছে।
এ বিষয়ে বিএনপি মধ্য সারির প্রভাবশালী এক নেতা বলেন, শীর্ষ পর্যায়ের রাজনীতি নিয়ে নানা মহলের গুজব উঠা অস্বাভাবিক নয়। নির্বাচনের আগে এমন গুঞ্জন ছিল যে, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে খালেদা জিয়া মুক্ত হবেন। এরপর নির্বাচনের পরে এখন আলোচনা হচ্ছে নির্বাচিত এমপিরা শপথ নিলে খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন। নির্বাচনের আগে যে কথা উঠেছিল তার কোন ভিত্তি বাস্তবে দেখা যায়নি। আর এখন যে আলোচনা আছে এর কোনো ভিত্তি আছে কিনা সময় বলে দেবে। কারণ গবেষকদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী গুজবের শতকরা ৭৫ ভাগ সত্য হয়।
প্রসঙ্গত, এক বছরের বেশি সময় ধরে কারাগারে আছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। গত ৮ ফেব্রম্নয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদন্ড দেন বিশেষ আদালত। কারাগারে থাকা অবস্থায় এই মামলায় উচ্চ আদালত তার সাজা আরও পাঁচ বছর বাড়িয়ে ১০ বছর করেছে। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের আরেকটি মামলায় তার সাজা হয়েছে সাত বছর। যে মামলায় খালেদা জিয়া কারাগারে আছেন, সেটিতে গ্রেপ্তারের দেড় মাসের মাথায় জামিন মিললেও তার মুক্তির পথে বাদ সেধেছে আরও ৩৫ মামলা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন