২১ আগস্টের নারকীয় গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের যাবজ্জীবন সাজা হওয়ায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম। যদিও এতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ অখুশি।
খুশির কারণ বলতে গিয়ে তিনি জানান, তারেকের মৃত্যুদণ্ড হলে তাকে দেশে ফেরত আনা হয়তো আটকে যেত, যে কারণে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না।
গ্রেনেড হামলার হোতা হিসেবে তারেক রহমানের সর্বোচ্চ সাজা না হওয়ায় আওয়ামী লীগ পুরোপুরি সন্তুষ্টও নয় বলে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নিজের প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন।
তবে এ রায়কে সঠিক ও ভালো বলছেন সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীদের অন্যতম নেতা আমীর।
তিনি বলেন, আমি মনে করি যে, এটি একটি খুব ভালো কাজ হয়েছে যে- তারেক রহমানকে শুধু যাবজ্জীবন দেয়া হয়েছে। এখন তাকে নিয়ে এসে সাজা খাটানোর জন্য পথটি অন্তত খুলে গেছে।
ব্যারিস্টার আমীর বলেন, সেদিক থেকে সরকার এম্বাসি, হাইকমিশন দিয়ে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেবেন বলে আমি আশা করি। তারেক রহমানকে সেখান থেকে নিয়ে এসে তার সাজা কার্যকর করা হবে।
সপরিবারে যুক্তরাজ্যে থাকা তারেকের বিরুদ্ধে এটিই প্রথম রায় নয়। এর আগে দুটি দুর্নীতির মামলায় তার ১০ ও ৭ বছর কারাদণ্ডের রায় হয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যামামলায় দণ্ডিত অনেকে বিভিন্ন দেশে অবস্থান করলেও তাদের ফেরত আনা যাচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে তাদের মৃত্যুদণ্ডের সাজাকে কারণ দেখানো হচ্ছে। কারণ ওই দেশগুলো মৃত্যুদণ্ডবিরোধী।
তা তুলে ধরে প্রবীণ আইনজীবী আমীর বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার আসামিদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে যে মৃত্যুদণ্ডের অজুহাতটা দেয়া হচ্ছে, এখানে সে অজুহাতের সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, এ রায়ে সুযোগ রাখা হয়েছে যাবজ্জীবন দিয়ে। কারণ তারেক রহমানের তো ফাঁসি হওয়ারই কথা। যাবজ্জীবন দেয়াটা ভালো সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে আমি মনে করি।
তারেককে লন্ডন থেকে ফেরাতে সরকারকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনতে কূটনৈতিক যে পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা দরকার, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিশ্চয়ই সেদিকে মনোযোগী হবে, যাতে দ্রুত এ সাজা বাস্তবায়ন হয়।
২০০৪ সালে এ হামলার পর সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল জানিয়ে আমীর বলেন, সে তদন্ত কমিটিতে সৈয়দ ইশতিয়াক আহমদ, ড. কামাল হোসেন, আমি এবং রাজশাহীর একজন আইনজীবী ছিলেন। পাঁচজন মিলে একটি রিপোর্ট করেছিলাম। সে রিপোর্টে আমরা সব কিছু নির্ণয় করেছিলাম। কারা, কীভাব ষড়যন্ত্র করেছিল, কীভাবে ঘটনা ঘটানো হয়েছিল, তার প্রত্যেকটি বিষয়ে আমরা লিখেছিলাম।
তিনি বলেন, সে রিপোর্টে আমরা বলেছিলাম- সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল এবং এর মূল উদ্দেশ্য ছিল- জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। এর মূল টার্গেটেই ছিলেন আমাদের জননেত্রী শেখ হাসিনা। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য এ ষড়যন্ত্রটি করা হয়েছিল।
একুশে আগস্টের এ হামলায় শেখ হাসিনা বেঁচে গেলেও প্রাণ হারিয়েছিলেন আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের ২৪ নেতাকর্মী, আহত হয়েছিলেন কয়েকশ।
আমীর বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের নজির কিন্তু খুব কম। এটি আমার কাছে মনে হয়, জালিয়ানওয়ালাবাগে যে হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল, তার চেয়েও নিকৃষ্ট। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডটি ষড়যন্ত্র করে করা হয়নি। কিন্তু এখানে একটি বিরাট ষড়যন্ত্র আয়োজন করা হয়েছে রাজনৈতিকভাবে একটি দলকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য, জাতীয় নেতৃত্বকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য।
বিএনপি এ রায়কে প্রত্যাখ্যান করে বলেছে- রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সরকারের ফরমায়েশে আদালতের এ রায় হয়েছে।
আমীর বলেন, রায় প্রত্যাখ্যান করাটা একটি অপসংস্কৃতি। একটি রাজনৈতিক দল বিলং করলেই আদালতের রায় মানি না, মানব না- এটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির খারাপ দিক। আদালতের রায় আইনগতভাবে আদালতেই মোকাবেলা করা উচিত। কিন্তু মানি না, মানব না- এটি এক ধরনের এনার্কিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি।
একুশে আগস্ট নারকীয় গ্রেনেড হামলার মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, এনএসআইয়ের সাবেক দুই মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিমসহ ১৯ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, সাবেক প্রতিমন্ত্রী কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদসহ ১৯ আসামিকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৯ আসামির মধ্যে দুই আসামি পলাতক ও যাবজ্জীবন দণ্ডিত ১৯ জনের মধ্যে ১২ আসামি পলাতক রয়েছেন। এ ছাড়া রায়ে আনসার ও ভিডিপির সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আমিন, সাবেক তিন আইজিপি- মো. আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরীসহ ১১ সাবেক সরকারি কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
এ ছাড়া রায়ে দণ্ডপ্রাপ্তদের ৫০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড দেয়া হয়।
বুধবার দুপুরে ঢাকার দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে স্থাপিত জনাকীর্ণ আদালতে এ রায় ঘোষণা করেন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় করা হত্যা ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে পৃথক দুটি মামলায় আসামিদের এ সাজা দেয়া হয়।
ভয়াবহ সেই ঘটনার ১৪ বছর এক মাস ২০ দিন পর চাঞ্চল্যকর এ দুটি মামলার রায় দেয়া হল। এর মধ্য দিয়ে ৪৯ আসামির সবারই সাজা হল। যদিও মামলার আসামি ছিল ৫২ জন।
এদের মধ্যে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, হুজি নেতা মুফতি আবদুল হান্নান ও শরিফ শাহেদুল ইসলাম বিপুলের অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় বর্তমানে আসামি ৪৯ জন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন