একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়া এবং বিদেশ থেকে পদত্যাগপত্র পাঠানোর ১১ মাস পরে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আ ব্রোকেন ড্রিম’ (ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন)- এ এমন একটি সময়ে ‘বোমা ফাটালেন’, যার মাস তিনেক পরেই জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা।
যে বইতে তিনি খোদ প্রধানমন্ত্রীর কড়া সমালোচনা করেছেন এবং কোন পরিস্থিতিতে তাকে দেশ ছাড়তে হয়েছে তার সবিস্তারে বর্ণনা দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি একটি গোয়েন্দা বাহিনীর সম্পর্কে এমন সব গুরুতর অভিযোগ এনেছেন, যা এর আগে কেউ করেননি বা করার সাহস দেখাননি।
ফলে প্রশ্ন হলো, যখন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বড় দুটি দলের বাইরেও ছোট ও মাঝারি দলগুলো জোটবদ্ধ হওয়ার রাজনীতিতে ব্যস্ত এবং আগামী একাদশ জাতীয় নির্বাচন কেমন হবে তা নিয়ে রাজনীতির মাঠে নানাবিধ বিতর্ক চলছে— এরকম একটি সময়ে তিনি বইটি কেন প্রকাশ করলেন? এর পেছনে নির্বাচনী রাজনীতির কোনো যোগসূত্র আছে কিনা বা এই বই লেখা ও প্রকাশের পেছনে কোনো রাজনৈতিক শক্তি ইন্ধন জুগিয়েছে কিনা?
প্রশ্ন উঠেছে, তিনি এইসব কথা বা অভিযোগ দেশে থাকতে কেন করতে পারলেন না? একজন প্রধান বিচারপতির এতটুকু সৎ সাহস কি ছিল না? এই কথাগুলো তাকে বিদেশে গিয়ে লিখতে হলো কেন?
তবে তিনি প্রধানমন্ত্রীসহ অন্য যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, তার সবই একপাক্ষিক। অর্থাৎ এই অভিযোগগুলোর বিষয়ে যেহেতু অভিযুক্তর কোনো বক্তব্য নেই, ফলে এসব কথা কতটা সত্য এবং মানুষ এর কতটুকু বিশ্বাস করবে বা করবে না—সেটি একান্তই তাদের ব্যক্তিগত বিষয়।
আরেকটি প্রশ্ন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক দল এবং ভোটারদের মধ্যে এই বইটি কোনো ধরনের প্রভাব ফেলবে কিনা? বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল এ বইটিকে কতটা আমলে নিয়েছে বা নেবে? আরেকটি প্রশ্নও আছে যে, যেহেতু এ বইয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা বাহিনীর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ করা হয়েছে, ফলে সিনহার বিরুদ্ধে এখন বিভিন্ন স্থানে রাষ্ট্রদ্রোহ এবং মানহানি মামলা দায়ের হবে কিনা? টেলিভিশনে ওয়ান ইলেভেন সম্পর্কে একটিমাত্র বক্তব্য দেয়ার কারণে সারা দেশে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে এরকম মামলা হয়েছিল। যদিও সেসব মামলা উচ্চ আদালত স্থগিত করে দিয়েছেন।
স্মরণ করা যেতে পারে, বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছ থেকে সংসদের ওপর ন্যস্ত করা সম্পর্কিত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পরই ক্ষমতাসীনদের সমালোচনার মুখে পড়েন এস কে সিনহা। এ সময় তার বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনসহ ১১টি অভিযোগও আনা হয় খোদ সুপ্রিম কোর্টের তরফে। শুধু তাই নয়, ওই রায়ে দেশের রাজনীতি, ক্ষমতা, ক্ষমতায়ন, গণতন্ত্র ইত্যাদি নানা বিষয়ে এস কে সিনহার দেয়া পর্যবেক্ষণেরও সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রীসহ সরকার দলীয় এমপি ও মন্ত্রীরা।
এরকম বাস্তবতায় গত বছরের অক্টোবরে দেশের বিচার বিভাগে এক অভূতপূর্ব কাণ্ড ঘটে যায়। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে একই বেঞ্চে বসতে অপারগতা জানান আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতি। এরপর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির অনুপস্থিতিতে আপিল বিভাগের জেষ্ঠ্যতম বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিয়াকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব দেয়া হয়।
২৫ দিনের অবকাশ শেষে ৩ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট খোলার দিনই অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে ১ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি এক মাসের ছুটিতে যান। এরপরই জানা যায় তিনি বিদেশে যাচ্ছেন। ১০ অক্টোবর তিনি আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে তার বিদেশ ভ্রমণের বিষয়টি চিঠি দিয়ে অবহিত করেন। ওই চিঠিতে ১৩ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি অস্ট্রেলিয়ায় থাকতে চান বলে উল্লেখ করা হয়।
১৩ অক্টোবর শুক্রবার রাতে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে দেশ ত্যাগ করার সময় বাসভবনের সামনে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় এক পাতার একটি বিবৃতি দিয়ে বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা হন। তিনি বলেন, ‘আমি অসুস্থ না, আমি অসুস্থ না। আমি ভালো আছি, আমি পালিয়েও যাচ্ছি না। আমি আবার ফিরে আসবো। আমাকে ছুটিতে যেতে বাধ্য করা হয়নি। আমি নিজে থেকেই ছুটি নিয়েছি।’
কিন্তু এই ঘটনার ১১ মাস পরে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে মি. সিনহা যে বইটি প্রকাশ করেছেন, সেখানে তিনি পরিস্কার করে লিখেছেন যে, সরকার তাকে জোর করে দেশছাড়া করেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, যাওয়ার সময়ে তিনি সাংবাদিকদের সামনে যে কথাগুলো বলেছিলেন সেটি সত্য নাকি এখন বইতে যা লিখেছেন সেটি? একজন সত্যিকারের সৎ মানুষের একই বিষয়ে দু’ধরনের স্ট্যান্ড হতে পারে না।
সরকার যদি ওই সময়ে তাকে জোর করেই দেশ ছাড়তে বাধ্য করে থাকে, তাহলে তিনি কেন সাংবাদিকদের বলতে পারলেন না যে, তাকে জোর করে পাঠানো হচ্ছে? তিনি কেন বলেছিলেন তিনি নিজেই ছুটি নিয়েছেন। একথা বললে কি তার বিরুদ্ধে যে ১১টি অভিযোগ আনা হয়েছিল সেই অভিযোগে তার বিচার হতো? যদি অভিযোগগুলো মিথ্যা হয়ে থাকে তাহলে একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিশ্চয়ই তিনি ন্যায়বিচার পেতেন। নাকি তাকে শর্ত দেয়া হয়েছিল যে, হয় দেশ ছাড়তে হবে না হয় বিচারের মুখোমুখি? যদি কেউ তার নিজের অবস্থানে সৎ থাকেন, তাহলে তার তো দ্বিতীয় শর্তটিই মানার কথা। আবার তিনি যখন স্বেচ্ছায় দেশ ছেড়ে যাচ্ছেন বলে জানিয়ে গেলেন, তখন বিদেশে গিয়ে কেন ঠিক তার উল্টো কথাগুলো লিখলেন?
যাই হোক, এসব প্রশ্নের জবাব তিনি নিজেই ভালো জানেন এবং ভবিষ্যতে কখনো সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলে নিশ্চয়ই এর জবাব পাওয়া যাবে। তবে এখন প্রশ্ন উঠেছে, জাতীয় নির্বাচনের মাস কয়েক আগে এরকম একটি বই প্রকাশ করে সিনহা ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষে একধরনের জনমত গড়ে তুলতে চাইছেন কিনা বা এই বই আগামী নির্বাচনে আদৌ কোনো প্রভাব ফেলবে কি না?
বইটি তিনি লিখেছেন ইংরেজিতে। তবে, বেশ সহজ সরল ভাষায়। মোটামুটি ইংরেজি জানা লোকই বইটি পড়তে পারেন। পুরো বইটি নিয়ে পাঠকের আগ্রহ না থাকলেও শেষের দুটি অধ্যায় যেখানে তিনি ষোড়শ সংশোধনীর রায় ঘোষণার পরবর্তী পরিস্থিতি এবং তার দেশ ত্যাগ ও পদত্যাগের বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন— যেসব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
বইটির মুদ্রিত ভার্সন এখনও বের হয়নি। অনলাইনে এবং পিডিএফ ভার্সন পাওয়া যাচ্ছে। বইটি নিয়ে এরইমধ্যে কথার লড়াই শুরু হয়েছে বড় দুই দলে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভাষায়, ‘ক্ষমতা হারানোর জ্বালায় তিনি মনগড়া কথা লিখেছেন’। আর বিএনপি নেতারা বলছেন, সরকার বিচার বিভাগের ওপর যে নগ্ন হস্তক্ষেপ করে, সিনহার বইয়ে সে কথাই ফুটে উঠেছে। বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান এবং আওয়ামী লীগ নেতা ইউসুফ হোসেন হুমায়ুনের অভিযোগ, একটি বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতেই নির্বাচনের আগে বইটি প্রকাশ করেছেন এস কে সিনহা। আর আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ভাষায়, এস কে সিনহার এই বইটি ‘পরাজিত ব্যক্তির হাহুতাশ’।
তবে এ বইটি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে খুব বেশি বিতর্ক হওয়ার সুযোগ নেই। এর প্রথম কারণ বইটি বিদেশি ভাষায় লেখা এবং এটির মুদ্রিত কপি এখনও প্রকাশিত হয়নি। অর্থাৎ সবার কাছে বইটি পৌঁছায়নি।
আর আমাদের দেশের মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ওই পর্যায়ে পৌঁছায়নি যে তারা একটি বই নিয়ে চায়ের দোকানে, রাস্তার মোড়ে, দলীয় অফিসে বসে আলোচনা করবে। সেটি হলে বরং দেশের রাজনীতিতে বড় ধরনের গুণগত পরিবর্তন আসতো। বরং এখন এস কে সিনহার বই নিয়ে টুকটাক আলোচনা যা হবে তা গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণ নিয়ে।
যারা এ নিয়ে কথা বলবেন, তাদের অধিকাংশই বইটি পড়বেন না বা পড়তে পারবেন না। রাজনৈতিক দলের নেতারাও যে বইটি পড়বেন, সেই সময় তাদের নেই। তাদের অনেক কাজ আছে। নির্বাচনের মাস কয়েক আগে এসে সাড়ে ছয়শ’ পৃষ্ঠার একটি ইংরেজি বই পড়ে তার বিচার বিশ্লেষণ করার মতো বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি এখনও আমাদের রাজনীতিকদের হয়নি। ফলে আমার ধারণা, যেহেতু বইটিতে সরাসরি ক্ষমতাসীনদের বিষোদ্গার করা হয়েছে, ফলে এটি নিয়ে তারা খুব বেশি মাথা ঘামাবে না।
পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি হয়তো এই ইস্যুতে কিছুদিন বক্তৃতার মঞ্চ গরমের চেষ্টা করবে; দলের সিনিয়র এবং আইনকানুন বোঝা নেতারা বইয়ের কিছু কিছু অংশ কোট করে সরকারের সমালোচনা করবেন— কিন্তু তাতে ভোটের মাঠে খুব বেশি প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না। এই বই পড়ে কেউ সরকারের প্রতিপক্ষ দলকে ভোট দেবে এবং আওয়ামী লীগের লোকজন সব বিএনপিতে যোগ দেবে, তার কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং শিক্ষিত শ্রেণির কিছু মানুষের মনে সিনহা সম্পর্কে সহানুভূতি তৈরি হবে— যদি তারা বইতে উল্লিখিত কথাগুলো বিশ্বাস করেন।
তবে ভোটের রাজনীতিতে এই বই কোনো প্রভাব বিস্তার করুক বা না করুক, বইটি যেহেতু ইংরেজিতে লেখা—ফলে প্রচুর বিদেশি পাঠক বইটি পড়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা লাভ করবেন।
বইতে একটি গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা বাহিনীর সম্পর্কে যা লেখা হয়েছে, সেগুলো যেকোনো নাগরিককেই উদ্বিগ্ন করবে। এসব অভিযোগের সত্যতা যাই থাকুক না কেন, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, যে কারণে এবং যে প্রক্রিয়ায় একজন প্রধান বিচারপতিকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল এবং বিদেশ থেকে পদত্যাগপত্র পাঠাতে হয়েছিল, সেটি যেকোনো দেশের বিচার বিভাগের জন্যই দুঃখজনক এবং অনাকাঙ্ক্ষিত।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন