মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী: বিএনপির প্রভাবশালী নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ নোয়াখালীতে তার নির্বাচনি এলাকায় দেওয়া ভাষণে বেশকিছু রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন, যা ইতোমধ্যেই ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে। তাই তা দেখা ও শোনারও সুযোগ হয়েছে। তবে ঈদ উপলক্ষে বন্ধ ও হকারদের ফিরে না আসার কারণে প্রিন্ট মিডিয়ায় ছাপানো বক্তব্য দেখা ও পড়ার সুযোগ হয়নি। মওদুদ আহমেদ যে কথাগুলো বলেছেন তার মধ্যে একটি হচ্ছে, বর্তমান স্বৈরসরকারের পতনের জন্য দেশে ঊনসত্তর ও নব্বইয়ের মতো গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করতে হবে। তিনি অচিরেই দেশে তেমন গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করতে হবে বলে দাবি করেন। মওদুদ আহমেদ অবশ্য লেখাপড়া জানা রাজনীতিবিদ। তাই তার কথাকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। মওদুদ আহমেদের কথা বিশ্বাস করলে বলতে হবে ১৯৯০-এর আন্দোলনে যে সরকারের পতন হয়েছিল সেই সরকারের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন তিনি নিজেই। ১৯৯০ সালে মওদুদ স্বৈরাচারী সরকারে ছিলেন, তার সরকারের পতন হয়েছিল। এটি সত্যি কথা। তবে তিনি তো তখন স্বৈরাচারী সরকারেই ছিলেন। প্রায় ৬ বছর তিনি যদি কোনো সামরিক সরকারে থাকতে পারেন তাহলে তিনি নিজেও তো একজন স্বৈরাচার ছিলেন। এর আগে তিনি জিয়াউর রহমানের সামরিক স্বৈরাচারী সরকারেও ছিলেন। যার সামরিক স্বৈরাচার সরকারের সঙ্গে এত বছর ধরে থাকা তিনি কি এরই মধ্যে সেই খোলস পাল্টে ফেলতে পেরেছেন? স্বৈরাচার এ যুগে গণতন্ত্র বিরোধী ভাবাদর্শের সরকার, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান। সাম্প্রদায়িকতা, বিকৃত জাতীয়তাবাদ ও উগ্র জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক কোনো দল, দলীয় নেতা যতই নিজেদের ‘গণতন্ত্রী’ বলে দাবি করেন তাদের হাতে পৃথিবীর কোথাও অসাম্প্রদায়িকতা, উদারবাদী গণতন্ত্র নিরাপদ থাকতে পারে না সেটি ইতিহাসই সাক্ষ্য দেয়। মওদুদ আহমেদ সেই ইতিহাস মোটেও কম জানেন না। তারপরও তিনি তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কাটিয়েছেন স্বীকৃত স্বৈরাচারী সরকার এবং তাদের গড়া রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে।
মওদুদ আহমেদ তার বক্তৃতায় আরও বলেছেন যে, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করে, তার ভাষায় বর্তমান স্বৈরাচারী সরকারকে হটানো যাবে না। তাই গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করতে হবে। মওদুদ সাহেব সুক্ষ্ম রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে আমজনতাকে বিভ্রান্ত করতেই এমন বক্তব্য দিয়েছেন। ১৯৬৯ এবং ১৯৯০-এর আন্দোলন নিয়মতান্ত্রিকভাবেই অভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছিল। যদিও ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান আর ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলন চরিত্রগতভাবে এক ছিল না। প্রথমটি ছিল গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থানের বিস্ফোরণ হিসেবেই। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তা আন্দোলনকে আরও উচ্চতায় নিয়েগিয়েছিল, এটির নেতৃত্ব দিয়েছিল গণতান্ত্রিক শক্তি। কিন্তু ১৯৯০ সালের গণআন্দোলন মূলত শহরকেন্দ্রিক ছিল। এর সংগঠক একক চরিত্র ছিল না। ফলে স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা ছড়িয়ে জনমতকে যেদিকে নেওয়া হয়েছিল তা গণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশকে এগিয়ে নেয়নি। বরং স্বৈরচারদের নিয়ে গড়া মওদুদ আহমেদের বর্তমান দলকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছিল, মওদুদ তখন পতিত স্বৈরাচারের দোসর ছিলেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে মওদুদ সাহেব গণতন্ত্র নিয়ে পুতুল নাচের আসর সাজিয়েছেন। সেই আসর কখন বসে, কখন কার সঙ্গে ভাঙে তা বোঝার রাজনৈতিক শিক্ষা আমজনতার নেই। তবে মওদুদ সাহেবদের ঢের রয়েছে। এখন দেখা যাবে ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে মওদুদ সাহেবের পুতুল নাচের আসরে কারা যোগ দেয়, যারা অভ্যুত্থান ঘটায়!! দেখার অপেক্ষায় আছি।
লেখক : অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, বাউবি
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন