জিসিসির নির্বাচনকে আগামী জাতীয় সংসদ ও অন্যান্য স্থানীয় নির্বাচনের টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে নিয়ে উভয় জোটের নেতৃবৃন্দ গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন। এ নির্বাচনের মূল ফ্যাক্টর গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকা ও আশপাশের এলাকার বিভিন্ন কারখানার শ্রমিক-কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। তাদের স্থায়ী ঠিকানা অন্য জেলায় হলেও কর্মক্ষেত্রের কারণে গাজীপুরে বসবাস করায় এ সিটি করপোরেশন এলাকার ভোটার হয়েছেন। এ ধরনের ভাসমান ভোটারের সংখ্যা লক্ষাধিক। প্রার্থীদের জয়-পরাজয় অনেকটা তাদের ভোটের ওপর নির্ভর করবে।
তাই এই ভোটারদের সমর্থন ও ভোট পেতে তাদের খোঁজে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থীগণসহ অন্য প্রার্থীরা হন্যে হয়ে ছুটছেন বিভিন্ন মিল-কারখানা ও আবাসিক এলাকাগুলোতে। রমজান শেষে ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে যাওয়া এসব ভোটারদের বেশির ভাগ বুধবার পর্যন্ত গাজীপুরে ফিরেননি। তাই প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকেরা ওই ভোটারদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে ভোট গ্রহণের নির্ধারিত দিনের (২৬ জুন) আগেই গাজীপুরে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। নির্বাচনী প্রচার ১৮ জুন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলেও প্রার্থীরা নানা কৌশলে কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে নির্ধারিত সময়ের অনেক আগে থেকেই নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছেন।
বিশেষ করে নির্বাচনে মেয়র পদে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ১৪ দলীয় জোট সমর্থিত আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী (নৌকা) অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম ও ২০ দলীয় জোট সমর্থিত বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী (ধানের শীষ) হাসান উদ্দিন সরকারের পক্ষে প্রতিদিনই উভয় জোটের শরিক দলের অর্ধশতাধিক কেন্দ্রীয় নেতার সমাগম ঘটছে গাজীপুরে। দলীয় প্রার্থীর বিজয়ের লক্ষ্যে প্রতিদিন তারা গাজীপুরে এসে স্থানীয় নেতা-কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ, উঠোন বৈঠক ও পথসভা করে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। বসে নেই প্রার্থীদের আত্মীয়স্বজন ও নারীকর্মী-সমর্থকেরাও। ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে তারা নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগ করছেন। প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকদের পদচারণায় ভোটারসহ স্থানীয়দের মধ্যে নির্বাচনী উৎসবের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ভোট গ্রহণের দিন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে ক্রমেই পাল্টে যাচ্ছে নির্বাচনী দৃশ্যপট। পুরো গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকা এখন নির্বাচনী উৎসবে মেতে উঠেছে।
এ দিকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের এ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে বুধবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার গাজীপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে সমন্বয় কমিটির বিশেষ আইনশৃঙ্খলা সভায় যোগ দেন। এ সভায় ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার, নির্বাচন কমিশনের কমিশনারগণ ও নির্বাচন কমিশনের সচিবসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের বিভিন্ন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বিকেলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অপর এক সভায় প্রার্থীদের সাথে মতবিনিময় করেন এবং বক্তব্য রাখেন।
মেয়র প্রার্থীদের গণসংযোগ
বিএনপি : ২০ দলীয় জোটের বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার (ধানের শীষ) কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নগরীর ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের বাঙ্গালগাছ বাজার, নীলের পাড়া, কানাইয়া বাজার, বালুচাকুলি এলাকায় গণসংযোগ করেন ও একাধিক পথসভায় বক্তব্য রখেন।
পথসভায় বক্তৃতাকালে হাসান উদ্দিন সরকার বলেন, আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে নির্বিচারে মিথ্যা কথা বলছেন। আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যাকাণ্ড নিয়ে তার মিথ্যাচার গাজীপুরের জনগণ কখনো বিশ^াস করবে না। এটি একটি সেটেল্ড বিষয়। গাজীপুরবাসী ভালো করেই জানেন আহসান উল্লাহ মাস্টারকে কারা হত্যা করেছে। জাহাঙ্গীর এখন ভোটের লোভে যা ইচ্ছা তাই বলছেন।
হাসান সরকার আরো বলেন, আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণের সাথে প্রতারণা করছেন। চীন ও জাপানের সহযোগিতায় গাজীপুর নগরী নিয়ে তিনি একটি মাস্টার প্ল্যান করেছেন এমন হাস্যকর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। তিনি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি না হয়েও কিভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় এবং কোন্ কোন্ নগরবিদের সহযোগিতায় এমন মাস্টার প্ল্যান করলেন তাকে (জাহাঙ্গীরকে) এই প্রশ্ন করার জন্য গণমাধ্যমকর্মীদের প্রতি অনুরোধ জানান হাসান সরকার। তিনি বলেন, তিনি যে ‘গ্রিন সিটি, কিন সিটি’র এই মাস্টার প্ল্যান করলেন তাহলে রাজউকের ডিটেইলস্ এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপের) কী হবে? কালীগঞ্জের সন্তান জাহাঙ্গীর আলম গাজীপুর নগরীর অনেক এলাকাই তো এখনো চিনেন না, তাহলে এই নগরী নিয়ে মাস্টার প্ল্যান করলেন কিভাবে?
পথসভায় গাজীপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী সাইয়েদুল আলম বাবুল বলেন, আজকাল লেখাপড়া না করেও নামের আগে অনেক লকব (পদবি) ব্যবহার করা যায়। নিজে পরীক্ষা দিয়ে সনদ লাভ করা, আর অন্যের দ্বারা পরীক্ষা দিয়ে সনদ লাভ করা সমান যোগ্যতা হতে পারে না।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও ধানের শীষের মিডিয়া সেলের প্রধান সমন্বয়কারী ডা: মাজহারুল আলম বলেন, সিটি করপোরেশনের ট্যাক্সকে যদি চাঁদাবাজির বৈধ হাতিয়ার মনে করেন এবং নিজে কত ভাগ খাবেন, কত ভাগ ওপর মহলে দেবেন এবং কত ভাগ সিটি করপোরেশনে খরচ করবেন কেউ কেউ এখনই এই হিসাব কষতে শুরু করেছেন বলে শুনা যাচ্ছে। যদি এমনই হয় তাহলে সিটি করপোরেশন হবে জনগণ নিষ্পেষিত হওয়ার আরেকটি হাতিয়ার। তিনি বলেন, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও ঝুট ব্যবসায় যাদের উত্থান তাদের দ্বারা এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা যায় না। তারা নিজেদের কল্যাণ ছাড়া জনগণের কোনো কল্যাণ কামনা করে না। তারা সব জায়গায় ভাগ বসাতে চাইবে। তারা জনগণের রক্ত চোষে খাবে। আর যারা জনগণের কল্যাণের জন্য রাজনীতি করেন তাদের দ্বারা জনগণের অমঙ্গল করা সম্ভব নয়।
এসব পথসভায় আরো বক্তব্য দেন, গাজীপুর সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জেলা বিএনপির সহসভাপতি আফজাল হোসেন কায়সার, জেলা বিএনপির সহসভাপতি আহমেদ আলী রুশদী, জেলা মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি আব্দুস সামাদ মোল্লা, কাপাসিয়া উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন সেলিম, জেলা হেফাজতে ইসলামীর যুগ্ম সম্পাদক মুফতি নাছির উদ্দিন, আশরাফ হোসেন টুলু, মনিরুজ্জামান লাবলু, ৩০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট মিলন উদ্দিন ভূঁইয়া, আসাদুজ্জামান সোহেল, কবির মন্ডল, নূর মুহাম্মদ প্রমুখ।
কানাইয়ার পথসভায় হাসান সরকার পাশের চিটার খালের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, এখানে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে এনে এই খাল খনন করেছিলাম। এই স্মৃতি কখনো মোছা যাবে না। এই খালের বদৌলতে এই এলাকার শত শত একর আবাদি জমিতে আজো ধান চাষ হচ্ছে। কাজেই এই এলাকার মানুষ ধানের শীষকে কখনো ভুলতে পারবে না।
গাজীপুর সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জেলা বিএনপির সহসভাপতি আফজাল হোসেন কায়সার বলেন, আজকাল মুরব্বিদের সম্মান দেয়া উঠে গেছে। মুরব্বিদের ইজ্জত না দেয়ায় সামাজিক অবক্ষয় শুরু হয়েছে। গণসংযোগ শেষে হাসান সরকার বিকেল ৩টায় বঙ্গতাজ অডিটোরিয়ামে সিইসি ও ইসিদের সভায় যোগ দেন। এ সময় তিনি আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিস্তর অভিযোগ তুলে ধরেন।
ধানের শীষের প্রচারণায় বেবী নাজনীন : গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে ২০ দলীয় জোট মেয়র পদপ্রার্থী মুক্তিযোদ্ধা হাসান উদ্দিন সরকারের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছেন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী বেবী নাজনীন, শায়লা, শিবা শানু, মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ শিল্পী। তারা গতকাল নগরীর হায়দরাবাদ, করমতলা, মাঝুখান, মিরের বাজারসহ পুবাইল অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় জেলা বিএনপির সভাপতি ও ধানের শীষ প্রতীকের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহবায়ক সাবেক এমপি ফজলুল হক মিলনের নেতৃত্বে গণসংযোগ করেন। তাদেরকে সহযোগিতা করেন পুবাইল অঞ্চলের প্রচারণার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিএনপির কেন্দ্রীয় সহস্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা: রফিকুল ইসলাম বাচ্চু।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন