মাহমুদুর রহমান
২০১৪ সালের জুন মাস পেরিয়ে গেল। পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহ তামাশার নির্বাচনের সরকার প্রধানকে কোন আনুষ্ঠানিক অভিনন্দন বার্তা না পাঠালেও জাপানী প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে সেপ্টেম্বরে দ্বি-পাক্ষিক সফরে ঢাকায় এসে দখলদার প্রধানমন্ত্রীকে বৈধতা দিয়ে গেলেন। তার সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের নির্বাচনে জাপানের পক্ষে বাংলাদেশের সমর্থন আদায় করা। অর্থাৎ স্বার্থ জড়িত থাকলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ন্যায়নীতির কোন মূল্য দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না! জাপানী প্রধানমন্ত্রীর সফরের অনেক আগেই অবশ্য ভারত, রাশিয়া, চীন ছাড়াও কয়েকটি ছোট-খাট দেশ শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়ে ফেলেছে। ইসলামী বিশ্বে একমাত্র ইসরাইলী এজেন্ট সিসির মিসর তাদের দৃষ্টিতে ‘চমৎকার’ নির্বাচনে বিজয়লাভের জন্য শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভিনন্দন জানাতে কোন রকম বিলম্ব করেনি। চীনের অভিনন্দন জানানোর পিছনে সম্ভবত: ব্যবসায়িক বিবেচনা প্রভাব ফেলেছে। দেশটির তৎকালিন রাষ্ট্রদূতের সাথে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের বিশেষ ব্যক্তিগত সম্পর্কও চীনের এই বিষ্ময়কর সিদ্ধান্ত গ্রহনে কাজ করে থাকতে পারে। পরবর্তীতে সেই রাষ্ট্রদূতকে বেইজিংয়ে হঠাৎ তলবের ঘটনা ঢাকায় যে সব গুজবের ডালপালা বিস্তার করেছে তার মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আর্থিক লেনদেনের বিষয়ও রয়েছে। যাই হোক, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের ঘটনা প্রবাহে আমরা অর্থাৎ কাশিমপুর কারাগারের বাসিন্দারা বুঝে গেলাম যে, কার্যকর আন্দোলন ছাড়া শেখ হাসিনাকে দিয়ে আর কোন নতুন কিংবা নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে বাধ্য করা যাবে না। কিন্তু, ৫ জানুয়ারীর পর পরই বিএনপি আন্দোলন স্থগিত করার ফলে নতুন করে সেটি শুরু করা সহজ কাজ ছিল না। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী বিএনপির একতরফা নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ আন্দোলন অব্যাহত রাখায় প্রথম অধিবেশনেই সংসদ ভেঙে দিতে হয়েছিল। এই উদাহরণ সত্ত্বেও বিএনপির নেতৃত্ব্ কেন ৫ জানুয়ারীর ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর আন্দোলন প্রত্যাহার করেছিলেন সেটা রহস্যাবৃতই থেকে গেছে।
এদিকে আন্দোলন প্রত্যাহারের সুযোগ নিয়ে শেখ হাসিনা ততদিনে তার পুলিশ, র্যাব এবং অস্ত্রধারী দলীয় ক্যাডারদের জনগনের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে। যে সকল জেলায় ২০১৩ এবং ২০১৪ সালে তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সেখানকার মানুষদের উপর নির্যাতনের কোন সীমা ছিল না। আমাদেরই করের টাকায় প্রতিপালিত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সে সব জেলায় ঘরে ঘরে ঢুকে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। বিশেষ করে সাতক্ষীরা, গাইবান্ধা, ঝিনাইদহ, লক্ষীপুর এবং চট্রগামে র্যাব, পুলিশ এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিজিবি যে জুলুম চালিয়েছে তার সঙ্গে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন দখলদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কেবল তুলনা চলে। কোন কোন সংবাদ মাধ্যমে এই খবর প্রকাশিত হয়েছিল যে সাতক্ষীরা অপারেশনে বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সীমান্তের ওপার থেকে এসে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীও যোগ দিয়েছিল। রাষ্ট্রযন্ত্রের অবর্ণনীয় অত্যাচারের মোকাবেলায় বেগম খালেদা জিয়া দেশব্যাপী গনসংযোগের কৌশল গ্রহন করলেন। তিনি বেশ কয়েকটি বিভাগীয় সফরে মহাসমাবেশে বক্তৃতা দিয়ে ভীত, সন্ত্রস্ত জনগনকে উদ্দীপ্ত করতে চাইলেন। আবারও আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হতে বললেন। প্রতিটি জনসভাতেই বিপুল জনসমাগম বিরোধী দলের নেতা, কর্মী, সমর্থকদের মধ্যে প্রানচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়। আমরা বন্দিরাও ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের মত আর একটি ব্যাপক গনআন্দোলনের প্রত্যাশা করতে থাকি। অপর দিকে ভারতের তাবেদার সরকার এবং তাদের দিল্লির প্রভুরা আন্দোলনকে নস্যাৎ করার ছক কষতে থাকে। অনেকটা আকষ্মিকভাবে ২০১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর গাজীপুরে নির্ধারিত বেগম জিয়ার মহাসমাবেশ সরকার বন্ধ করে দেয়। সরকারের অগনতান্ত্রিক পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়া দেখাতে গিয়ে বিএনপি সিদ্ধান্তহীনতার পরিচয় দিলে আমাদের কাছে মনে হতে থাকে যে, এক বছরের মাথায় আর একটি আন্দোলনের জন্য হয়ত বিরোধী জোট প্রস্তুত নয়। জেলের ভিতর থেকে আমরা শুনতে পেলাম যে, বেগম জিয়া সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জনসভার জন্য নির্ধারিত দিনেই ঢাকা থেকে গাজীপুরের উদ্দেশ্যে পদযাত্রা করবেন এবং পুলিশ যেখানে বাধা দেবে সেই স্থান থেকেই অবস্থান কর্মসূচীর মাধ্যমে চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু হবে। পরবর্তীতে পদযাত্রা বাতিল করে গাজীপুরে হরতালের কর্মসূচি দেওয়া হয়। গাজীপুরের ঘটনার মাধ্যমে প্রমানিত হয় যে, বৃহত্তর ঢাকায় বিএনপির সাংগঠনিক দূর্বলতা ২০১৩ সালের পর্যায়েই রয়ে গেছে। ঢাকা মহানগর বিএনপির দায়িত্ব ততদিনে সাদেক হোসেন খোকার পরিবর্তে মির্জা আব্বাসের হাতে সমর্পিত হলেও মাঠের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারীর গনতন্ত্র হত্যা দিবসে ঢাকায় কার্যকর আন্দোলনের সূচনা করতে বিরোধী জোট পুনরায় ব্যর্থ হলো। সেদিন প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের নেতৃত্বে একটি পেশাজীবী সমাবেশ ছাড়া রাজনৈতিক নেতৃবর্গ রাজধানীর কোথাও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সমর্থ হয়নি। সারা শহরে কোন রাজনৈতিক সমাবেশ অথবা বিক্ষোভ খুঁজে না পেয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শেষ পর্যন্ত প্রেসক্লাবের পেশাজীবী সমাবেশেই যোগদান করতে বাধ্য হলেন। সেই সমাবেশেও পুলিশের সহায়তাক্রমে ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা হামলা চালালে বেশ কয়েকজন পেশাজীবী আহত হন। বিএনপি মহাসচিব এক রাত প্রেসক্লাবে অবরুদ্ধ থেকে ৬ জানুয়ারী ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। বেগম খালেদা জিয়াও তখন গুলশানের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অবরুদ্ধ। সেখান থেকেই তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের দীর্ঘতম অবরোধ আন্দোলনের ডাক দিলেন।
২০১৫ সালের আন্দোলনের প্রারম্ভ থেকেই বিরোধী দলের প্রস্তুতিহীনতা দৃশ্যমান হতে শুরু করে। সারা দেশের আন্দোলনের তীব্রতা ২০১৪ সালের অনুরুপ না হলেও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা সাধ্যমতো মাঠে নেমেছিল। কিন্তু ঢাকা আবারও হতাশ করলো। আন্দোলনের আগে সভা-সমাবেশে বিএনপির মহানগর নেতৃত্ব নানারকম আশার বানী শোনালেও কার্যক্ষেত্রে সাহসের অভাব দেখা গেল। এক বছর আগের আন্দোলন থেকে সরকার শিক্ষা নিয়ে পুরো রাজধানী পোষাকধারী এবং সাদা পোষাকের পুলিশ দিয়ে ভরে ফেললেও তার মোকাবেলায় বিরোধী দল কোন নতুন কৌশল গ্রহন করতে পারেনি। বিচ্ছিন্নভাবে যানবাহন চলাচলে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উপর ইট-পাটকেল অথবা একটা-দুটো ককটেল ছুড়ে ফ্যাসিস্ট শাসনযন্ত্রে চিড় ধরানো সম্ভব ছিল না। বরঞ্চ, পুরনো ধাঁচের আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে সরকারী দল ন্যায্য, গনতান্ত্রিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে সহিংসতার প্রচারনা চালাতে সক্ষম হয়। সেই প্রচারনার পালে বাতাস দেয়ার অংশ হিসেবে সরকারের এজেন্সিসমূহ নিজেরাও সহিংসতা ঘটায়। সেই সময় বাস ট্রাকে আগুন দেয়ার যে সব ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে কতগুলো বিরোধীদল করেছে আর কতগুলো এজেন্সীর কীর্তি এ নিয়ে জনমনে ভালরকম সন্দেহ রয়েছে। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে শীতের রাতে দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখা ঢাকাগামী চলমান বাসের ভিতরে কী করে পিকেটারদের পক্ষে আগুন দেয়া সম্ভব হয়েছিল সেই রহস্যের কিনারা আজ পর্যন্ত হয়নি! এই বাস পোড়ানো মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামী করা হলেও প্রকৃত আসামী হয়ত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অথবা গনভবন কিংবা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দেশব্যাপী অসংখ্য স্থাপনার মধ্যে কোথাও নিরাপদেই আছে।
সমস্তটা জীবন ধরে ট্রাজেডী নিয়েই চলা বেগম জিয়ার জীবনের সব চাইতে বড় ট্রাজেডী ঘটে যায় আন্দোলন চলাকালিন সময়েই। এক এগারোর সামরিক সরকার দ্বারা শারীরীকভাবে নির্যাতিত এবং বর্তমানে দখলদার মামলাবাজ সরকার কর্তৃক নির্বাসিত শহীদ জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মালয়শিয়ায় আকষ্মিকভাবে ইন্তেকাল করেন। বলা হয়ে থাকে যে পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ নাকি সবচেয়ে ভারী। তাহলে মায়ের সামনে পুত্রের লাশকে কার সাথে তুলনা করবো? চানক্য কৌশল প্রয়োগে অতি পারদর্শী শেখ হাসিনা ১৯৮১ সনে ভারতের আশ্রয়ে থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর পদ গ্রহন করার পর থেকে এ যাবত কত বার যে, তার পারিবারিক জীবনের ট্রাজেডি নিয়ে জনসম্মুখে আহাজারি করেছেন তার ইয়ত্তা নাই। স্বামী, পুত্র, কন্যা নিয়ে ভরভরন্ত সংসার থাকা সত্ত্বেও জনগনের করুণা নেয়ার অভিপ্রায়ে তিনি ‘আমার কেউ নাই’ জাতীয় রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে খুবই পছন্দ করেন। অথচ বেগম জিয়ার ট্রাজেডি শেখ হাসিনার চেয়ে কোন অংশে কম হৃদয়বিদারক নয়। প্রায় তারুন্যে তার স্বামী প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান শহীদ হয়েছেন। দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে বেগম জিয়ার বৈধব্য চলছে। এক এগারোর সময় তার চোখের সামনে দিয়ে দুই পুত্রকে চোখ বেধে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দিল্লির প্ররোচনায় দেশপ্রেমিকের দাবীদার সেনাবাহিনী অমানুষিক নির্যাতন করে দুই জনকেই পঙ্গু করেছে। বড় ছেলে তারেক রহমান ২০০৮ সাল থেকে লন্ডনে নির্বাসিত। ছোট ছেলেটিও নির্বাসনে থেকে অকালেই ঝরে গেল। এর আগে মইন-ফখরুদ্দিনের জমানায় বন্দী অবস্থায় তিনি বৃদ্ধা মা’কেও হারিয়েছেন। অর্থাৎ ¯েœহময়ী মা এবং ¯েœহের সন্তান, কারো মৃত্যুর সময়ই খালেদা জিয়া কাছে থাকতে পারেননি। এই নারী ছোট ভাই সাইদ ইস্কান্দারকেও অকালে হারিয়েছেন। প্রিয়জনের মৃত্যুর মিছিল তার জীবনেও কম দীর্ঘ নয়। এক ভয়ংকর ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে দশকেরও বেশি সময় ধরে লড়াই করতে করতে বেগম জিয়া আজ অশক্ত এবং জনমানবহীন এক পরিত্যক্ত জেলখানায় বন্দী। কিন্তু, দৃঢ় প্রত্যয় এবং প্রচন্ড আত্মসম্মানের অধিকারীনি এই সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার পর কেবল একটিবার ছাড়া কখনও জনসমক্ষে অশ্রু ঝরাননি। বাংলাদেশের জনগন একটি দিনই তার কাছ থেকে ব্যতিক্রম দেখতে পেয়েছিল। যেদিন প্রায় তিন দশক আগে, আইনানুগভাবে প্রাপ্ত তারই বাড়ী থেকে আদালতের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে তাবেদার সরকার তাকে উচ্ছেদ করেছিল সেই দিনটিতে বেগম জিয়া আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। হয়ত স্বামীর স্মৃতি বিজড়িত এতদিনের সংসার থেকে এভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কষ্ট সহ্য করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিংবা যে সেনাবাহিনীকে তিনি আপন পরিবার বিবেচনা করতেন তাদের নির্দয় নির্লিপ্ততায় ব্যথিত হয়েছিলেন। দলের ব্যর্থতাও নিশ্চয়ই তাকে হতাশ করেছিল। অপরিসীম বেদনার ভারে তিনি ওই একটি বারের জন্যেই ক্যামেরার সামনে ভেঙ্গে পড়েছিলেন।
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন অবৈধ শাসককুল এতটাই নির্মম যে, তারা বেগম জিয়ার পুত্র শোককেও রাজনীতির নোংরা খেলায় ব্যবহার করেছে। শেখ হাসিনা যিনি প্রায় প্রতিদিন বিচারবহির্ভূত হত্যা কিংবা গুমের নির্দেশ দেন, তিনিই রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য খালেদা জিয়াকে সান্তনা দেয়ার ছলে তামাশা করতে অবরুদ্ধ নেত্রীর গুলশান কার্যালয়ে সদলবলে হাজির হয়েছিলেন। সদ্য পুত্রহারা কোন শোকাতুরা মায়ের পক্ষেই স্বয়ং নির্যাতনকারীর সঙ্গে দেখা করা সম্ভব নয়। তাই খালেদা জিয়া বিশ্বের একমাত্র নারী ফ্যাসিস্ট শাসকের সঙ্গে সাক্ষাতে অসম্মতি জ্ঞাপন করে কোন অপরাধ করেননি। বরঞ্চ দেখা করলেই তার প্রানপ্রিয় সন্তানের স্মৃতির প্রতি অসম্মান জানানো হতো। সেই সময়ের পরিস্থিতি ভুলে কিংবা এড়িয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নাই। শেখ হাসিনার নির্দেশে পুলিশ মাসের পর মাস গুলশান কার্যালয় অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছিল। দলের নেতা, কর্মী, সমর্থক তো দূরের কথা, দেশের কোন সাধারন নাগরিকেরও বেগম জিয়ার সাথে দেখা করে সহমর্মিতা প্রকাশের কোন সুযোগ ছিল না। বেগম জিয়াসহ কার্যালয়ে অবরূদ্ধ মানুষগুলো অর্ধাহারে, অনাহারে দিন কাটিয়েছেন। সারা দেশে বিরোধী দলের অসংখ্য নেতা-কর্মীকে বিনা বিচারে হত্যা করা হয়েছে। নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে পঙ্গু হয়েছে হাজার হাজার তরুন। গনতান্ত্রিক অধিকারের জন্য লড়াইরত নাগরিকদের দিয়ে দেশের সকল কারাগার ভরে ফেলা হয়েছিল। এহেন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে মৌখিক সহানুভূতি শ্রবন কারার মত মানসিকতা সঙ্গত কারনেই শোকাতুর বেগম খালেদা জিয়ার থাকতে পারে না। তাছাড়া শেখ হাসিনা গুলশান কার্যালয়ে নিশ্চয়ই একাকী প্রবেশ করতেন না। তারা সঙ্গে বেসুমার নিরাপত্তা রক্ষীরা ছাড়াও বিভিন্ন এজেন্সির লোকজন সেখানে ঢুকতো। সেই লোকেরা যে বেগম জিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতো না তার গ্যারান্টি কে দিত? এরাই তো বাংলাদেশে সকল প্রকার গুম-খুন এবং বিচার বহির্ভূত হত্যায় সিদ্ধহস্ত। তারা ভিতরে ঢোকার সুযোগ নিয়ে সেখানে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র, মাদক অথবা বিস্ফোরক দ্রব্য রেখে আসতে পারতো। চানক্য এবং মেকিয়াভেলির রাজনীতিতে ন্যায়-অন্যায়, আইন, বিবেক, ইত্যাদির কোন স্থান নেই। চানক্যের শিষ্যাকে বেগম খালেদা জিয়া বিশ্বাস না করতে পেরে থাকলে সেটা ভয়ানক অপরাধ হয়ে গেছে বলে যারা মনে করেন তারা প্রকৃতপক্ষে ফ্যাসিবাদেরই ছদ্মবেশী দোসর।
বাংলাদেশের এক শ্রেণির সুশীলরূপী আওয়ামী দালাল শেখ হাসিনাকে গুলশান কার্যালয়ে ঢুকতে না দেওয়ার জন্য বেগম জিয়ার কঠোর সমালোচনা করে থাাকেন। সেই সময় এই সমালোচনাকারীদের মধ্যে ব্যারিস্টার রফিকুল হকের নাম দেখে যারপরনাই অবাক হয়েছিলাম। কাশিমপুর জেলে সেই সংবাদ পত্রিকায় পড়ার পর আমার মনে পড়ে গিয়েছিল যে, বাংলাদেশের অন্যতম প্রখ্যাত এই প্রবীন আইনজীবীকে স্বয়ং শেখ হাসিনা কত অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেছেন। সম্ভবত: কোন এক টকশো’তে ব্যারিস্টার রফিকুল হক সরকারের অগনতান্ত্রিক কার্যকলাপের সমালোচনা করেছিলেন। তাতেই বেজায় রাগান্বিত হয়ে শেখ হাসিনা তার বিরুদ্ধে এক এগারো সরকারের দায়েরকৃত ডজন খানেক দূনীতি মামলায় তারই পক্ষের আইনজীবী রফিকুল হককে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে মন্তব্য করেছিলেন, ‘মুই কার খালু রে’। আসলে শেখ হাসিনা বড়ই সৌভাগ্যবতী। বাংলাদেশের ভারতীয় দালাল সুশীল(?) শ্রেণির কাছে শেখ হাসিনা দেবীতুল্য। দেবীর গালাগাল কী আর গায়ে মাখতে আছে? তাছাড়া সাহসেরও তো একটা ব্যাপার আছে। খালেদা জিয়াকে সমালোচনা করে যত সহজে পার পাওয়া যায় শেখ হাসিনার বেলায় সেটা সম্ভব নয়। এইসব সুশীলরা ভাল করেই জানেন যে শেখ হাসিনা কুপিত হলে তাদের ভিটে মাটিতে ঘুঘু চড়িয়ে দিতে মোটেই দ্বিধা করবেন না। এই প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের এক সময়ের প্রেসিডিয়াম সদস্য সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের মন্তব্য স্মরণ করিয়ে দেয়া যেতে পারে। নিজের নেত্রী সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন যে বাঘে ধরলে বাঘে ছাড়ে, কিন্তু শেখ হাসিনা কাউকে ধরলে ছাড়ে না।
২০১৫ সালের আন্দোলনও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থই হলো। বিশ্বের সকল গনতান্ত্রিক আন্দোলন সফল হয়না। তাতে আন্দোলনের ন্যায্যতার কোন হের-ফের হওয়া উচিৎ নয়। ২০১৪ সালের দেশব্যাপী অসাধারন সাহসিকতাপূর্ন আন্দোলন মোকাবেলা করেও শেখ হাসিনার অবৈধ সরকার দিল্লির প্রত্যক্ষ মদদে টিকে গেছিল। এতদসত্ত্বেও জনসমর্থন কিংবা সাংগঠনিক শক্তি কোন বিচারেই বিএনপিও কিন্তু সেবার পরাজিত হয়নি। স্বল্প সময়ের মধ্যেই দলটি রুখে দাঁড়িয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়ার ২০১৪ সালের বিভিন্ন বিভাগীয় মহাসমাবেশে যে অভূতপূর্ব জনসমাগম ঘটেছিল তার মাধ্যমে বিএনপির তৃনমূলের শক্তি ও সমর্থন প্রকাশিত হয়েছিল। দূর্ভাগ্যবশত: ২০১৫ সালের আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ার পর দলটির নৈতিক বলে রাতারাতি যেন ধ্বস নেমে গেল। কাশিমপুর জেলে অবস্থান কালে বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতৃবৃন্দের মুখে আমি ২০১৫ সালের আন্দোলনের সমালোচনা শুনেছি। তারা এটিকে হঠকারী কার্যকলাপ বিবেচনা করতেন। মার্চ মাসের মধ্যে কাশিমপুর জেল বিএনপি, জামায়াত এবং বিশ দলের নেতা-কর্মীদের দিয়ে ভরে গিয়েছিল। অসংখ্য নেতা-কর্মীদের মধ্যে পুরনো ঢাকার ছাত্র দলের একজন কর্মীর কথা প্রায়ই মনে পড়ে। তরুনটিকে থানায় নিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকারের পুলিশ হাঁটুতে শটগান ঠেকিয়ে গুলি করে নি-ক্যাপ (Knee Cap) উড়িয়ে দিয়েছিল। সদা হাস্যময় ছেলেটিকে ক্রাচে ভর দিয়ে জেলের ভিতর হাঁটতে দেখলে আমারও চোখ ভিজে আসতো। আমাকে সে একদিন বলেছিল, “তবু তো স্যার বেঁচে আছি। আমার কত বন্ধুকেই তো গভীর রাতে থানার গারদ থেকে বের করে নিয়ে গুলি করে মেরে পুলিশ বন্ধুকযুদ্ধের গল্প সাজিয়েছে।” শেখ হাসিনা এবং তার পুলিশ বাহিনীর হাত কত নিরাপরাধ মানুষের রক্তে যে রঞ্জিত হয়ে আছে তার হিসাব একদিন ইতিহাস করবে।
আন্দোলনের এক পর্যায়ে শুনতে পেলাম রুহুল কবীর রিজভী গভীর রাতে পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে এপোলো হাসপাতাল থেকে নিরুদ্দেশ হয়েছে। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই বিএনপির এই সাহসী নেতা আত্মগোপনে থেকেই আন্দোলনের কর্মসূচী দিতে লাগলো। কদিনের মধ্যেই সে আবার গ্রেফতার হয়ে গেল। কারাগারে না আসা পর্যন্ত রিজভীর নিরাপত্তা নিয়ে কাশিমপুরে আমরা সবাই বড়ই উদ্বেগে ছিলাম। রিজভীর গ্রেফতারের পর কর্মসূচির ঘোষনার দায়িত্ব নিয়েছিল কক্সবাজারের সালাহ উদ্দিন আহমেদ। কিছুদিন না যেতেই সরকার তাকেও গুম করে ফেললো। বেশ কয়েকমাস পর সালাহউদ্দিনকে ভারতের শিলং শহরে জীবিতই পাওয়া গেল। অর্থাৎ বিএনপির এই নেতাকে গুম এবং পাচারের প্রক্রিয়ায় ঢাকা এবং দিল্লি যৌথভাবে অপারেশন চালিয়েছে। কারা তাকে উত্তরা থেকে গুম করেছিল, কোথায় তাকে দীর্ঘদিন রাখা হয়েছিল এবং কেমন করে সীমান্তোর ওপারে নিয়ে যাওয়া হলো এ সব প্রশ্নের জবাব বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট ও তাবেদার সরকারের পতনের আগে পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।
অবরোধ চলাকালে ঢাকার আদালতে হাজিরা দেয়ার জন্য আমাকে একাধিকবার কাশিমপুর থেকে আনা হয়েছিল। রাস্তা-ঘাটে প্রচুর যানবাহন দেখতে পেয়ে টের পাচ্ছিলাম আন্দোলন গতি হারাচ্ছে। বড় হতাশ হয়ে সেই সময় দিনশেষে জেলে ফিরে যেতাম। এক সময় বেগম জিয়াও বাস্তবতা মেনে নিলেন। আলিয়া মাদ্রাসার ক্যাঙ্গারু আদালতে হাজিরা দিতে তিনি দীর্ঘ দুই মাস পর গুলশান কার্যালয় ছেড়ে জনসমক্ষে এলেন। হাজিরা শেষ করে ফিরলেন তার গুলশানের ভাড়া করা নির্জন বাসভবনে। বিশ্রামের কোন সময় পেলেন না। পুত্র শোকে কাতর, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, শারীরীকভাবে দুর্বল সত্তরোর্ধ এই নারী দল পুনর্গঠনের কৌশল ঠিক করতে মনোনিবেশ করলেন। (চলবে)
সম্পাাদক, দৈনিক আমার দেশ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন