রাজনীতিতে হঠাৎ করেই উঠে এসেছে তারেক রহমান প্রসঙ্গ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও অন্য দলের নেতাদের আলোচনায় এখন সরগরম রাজনীতি। এ ছাড়া নেতাদের মুখে তারেক রহমানের নাগরিকত্বের বিষয়টিও উঠে এসেছে। মূলত তারেক রহমানকে ফিরিয়ে এনে বিচার করা হবেÑ লন্ডনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন বক্তব্যের পর বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে নতুন করে আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি হয়। তারেক রহমান পাসপোর্ট ‘সমর্পণ’ করে নাগরিকত্ব ‘বর্জন’ করেছেনÑ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এটি ‘মিথ্যা’ দাবি করে উকিল নোটিশও পাঠিয়েছেন তারেক রহমান।
আইনমন্ত্রী বলেছেন, তারেক রহমানকে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে। যদিও সরকারি অন্তত দুটি সূত্র বলেছে, তারেক রহমানকে ফিরিয়ে আনতে হলে অনেক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। সূত্রগুলো আরও বলেছে, তারেক রহমানকে দেশে ফেরাতে রয়েছে আইনি জটিলতাও। বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময় তারেক রহমান কোন স্ট্যাটাসে যুক্তরাজ্যে আছেন, তা জানতে চেয়েও কোনো জবাব পায়নি।
গত শনিবার লন্ডনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, তারেক রহমান বাংলাদেশের সবুজ পাসপোর্ট হাইকমিশনে জমা দিয়ে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বর্জন করেছেন। সেই তারেক রহমান কীভাবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন?
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ‘বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বর্জন করেছেন’ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের এমন বক্তব্যের প্রতিবাদে তাকে আইনি নোটিশ দেওয়া হয়েছে। গতকাল তারেক রহমানের পক্ষে দুপুরে সরকারি ডাকযোগে নোটিশটি পাঠান তারেক রহমানের আইনজীবী ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল। একইসঙ্গে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করায় ২টি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদককে আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে। আগামী ১০ দিনের মধ্যে বক্তব্য প্রত্যাহার না করলে, প্রতিমন্ত্রীসহ ওই তিনজনের বিরুদ্ধে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনে আলাদাভাবে মামলা করা হবে বলে জানান কায়সার কামাল।
নোটিশের জবাবে গতকাল সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, আমি শুনেছি একটি উকিল নোটিশ আমার নামে পাঠানো হয়েছে। একটি বিষয় ভালো লাগল, বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি তাদের আস্থা বোধ হয় পুনঃস্থাপিত হয়েছে। কারণ প্রতিনিয়ত তারা আস্থাহীনতার কথা বলেন। একজন কনভিকটেড ক্রিমিনাল এরকম একটি ভ্যালিড ডকুমেন্টের প্রেজেন্টেশনের পরও কীভাবে উকিল নোটিশ দেন, এটি খুবই মজার বিষয়। তারা যদি মামলা করতে চান, তাহলে আমরা অবশ্যই তা মোকাবিলা করব।
যুক্তরাজ্যের হোম অফিসের মাধ্যমে তারেক রহমানের পাসপোর্ট বাংলাদেশ হাইকমিশনে জমা দেওয়ার একটি নথি দেখিয়ে শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘তার হিসাবে’ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এখন আর বাংলাদেশের নাগরিক নন। তিনি বলেন, তারেক ব্রিটিশ হোম অফিসের মাধ্যমে ২০১৪ সালের ২ জুন তার নিজের, স্ত্রীর এবং মেয়ের পাসপোর্ট লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে ‘ফেরত পাঠান’। এত কিছুর পরও যদি কারো কোনো প্রশ্ন থাকে, বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী দলের কেউ যদি আগ্রহী হন, আমরা ব্যবস্থা করব। লন্ডনে আমাদের বাংলাদেশ হাইকমিশনে গিয়ে দেখে আসবেন।
তারেক রহমানের আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, তারেক রহমানের বিষয়টি নিয়ে নোংরা রাজনীতি করছে সরকার। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ২০১৪ সালে তারেক রহমান নাগরিকত্ব বাতিল করেছেন। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে এতদিন পর কেন তিনি বিষয়টি তুললেন। আসলে সরকার এটি নিয়ে রাজনীতি করছে।
তারেক রহমানের আইনজীবী ব্যারিস্টার মীর হেলাল বলেন, কোথাও পাসপোর্ট জমাদান মানে এই না যে, নাগরিকত্ব বর্জন করা। পাসপোর্ট হচ্ছে একটি ট্রাভেল ডকুমেন্ট। বিদেশে পরিচয় শনাক্ত করার জন্য পাসপোর্ট ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
গত মঙ্গলবার বিকালে লন্ডনে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারেক রহমানকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আমরা যুক্তরাজ্য সরকারের সঙ্গে কথা বলছি এবং অবশ্যই একদিন তাকে দেশে ফিরিয়ে আনব। তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।
গত রবিবার এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানকে লন্ডন থেকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্য সরকার আগ্রহ দেখানোর কারণেই বাংলাদেশ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে তারেক রহমানের পাসপোর্ট জমার বিষয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। গতকাল নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির পক্ষে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নির্জলা মিথ্যা কথা বলেছেন। আমি চ্যালেঞ্জ দিচ্ছিÑ জিয়া পরিবারের কোনো সদস্যের বিদেশি নাগরিকত্ব নেই। তারেক রহমান যদি বাংলাদেশি পাসপোর্ট লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে জমা দিয়ে থাকেন, তা হলে সেটি প্রদর্শন করুন। হাইকমিশন তো সরকারের অধীনেই, তাদের বলুন সেটি দেখাতে।
এদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে বাংলাদেশি পাসপোর্ট থাকলে তা দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। গতকাল আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানম-ির রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের পক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে এ আহ্বান জানান।
এদিকে তারেক রহমানকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার প্রক্রিয়া চলমান। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে আইনি বাধা থাকলেও বিদ্যমান মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসট্যান্স অ্যাক্টের আওতায় কূটনৈতিক তৎপরতার মধ্য দিয়ে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্য সরকারের মধ্যে বন্দিবিনিময় চুক্তি না থাকায় এ পথে এগোতে পারে সরকার। এমনটাই জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী।
আসামি প্রত্যর্পণের বিষয়ে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বর্তমানে কোনো চুক্তি নেই বাংলাদেশের। তবে যুক্তরাজ্যের আসামি প্রত্যর্পণ আইন ২০০৩-এ বলা আছেÑ কোনো দেশ তার অভিযুক্ত আসামিদের ফিরিয়ে নিতে পারে। এজন্য দূতাবাস কিংবা সরকারের বিশেষ প্রতিনিধির মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আবেদন করতে হবে। ওই আবেদনের সঙ্গে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ, যদি দ-প্রাপ্ত হয়ে থাকে তাহলে সংশ্লিষ্ট মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি জমা দিতে হয়। এ ছাড়া এটাও নিশ্চিত করতে হবে, ওই ব্যক্তিকে দেশে ফিরিয়ে এনে মৃত্যুদ- দেওয়া হবে না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন