খুলনা ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ভোট আগামী ১৫ মে। আর জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে চলতি বছরের শেষ বা আগামী বছরের শুরুর দিকে। এসব নির্বাচনকে সামনে রেখে ঘুরেফিরে আলোচনায় সেনা মোতায়েনের বিষয়টি। এ নিয়ে বিএনপি-আওয়ামী লীগ পরস্পরবিরোধী কথা বলছে। তাদের অবস্থান বিপরীত মেরুতে।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা উচিত- এ ধরনের একটি মন্তব্য করে কয়েক মাস আগে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বিপাকে পড়েছিলেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা পাল্টা মন্তব্য করে বলেছিলেন, কমিশনে এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আবার কয়েক দিন আগে সিইসি বললেন, নির্বাচনের সময় সেনা মোতায়েন থাকা উচিত।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এটা তার ব্যক্তিগত মত। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের শরিকরা সবাই এক সুরে নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের পক্ষে বলেছেন, এমনকি কেউ কেউ ওই সময় সেনাবাহিনীকে ‘ম্যাজিস্ট্রেসি’ ক্ষমতা দেওয়ারও প্রস্তাব করেন। আমাদের সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে লেখা আছে, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে।’
এর মানে বোঝা কঠিন নয়। নির্বাচন কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের যে বাধ্যবাধকতা আছে, তা সংবিধানের এ অনুচ্ছেদটিতেই ইঙ্গিত দেওয়া আছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৯ থেকে ১৩১ ধারায়ও এ সম্পর্কে বলা আছে।
গত ২১ এপ্রিল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় বলেন, আমাদের বুঝে আসে না আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন হলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমস্যা কোথায়? তাদের (আওয়ামী লীগ) কাছে সেনাবাহিনী স্পর্শকাতর। কারণ, তারা ভয় পাচ্ছেন নিজেদের দুর্বলতার কারণে। কোনো সমস্যা অবশ্যই আছে, না হলে তাদের ভয় কেন? আগামী সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা প্রত্যাশা করছেন আমির খসরু।
অন্যদিকে গত ২০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের রাজধানীর কাকরাইলে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আমরা কিন্তু কখনো বলি না সেনাবাহিনী মোতায়েন হবে না। প্রয়োজন হলে সেনা মোতায়েন হবে। তবে পরিস্থিতি বলে দেবে সেনা মোতায়েন হবে কি না; কিন্তু আপনারা এখন সেনাবাহিনী, সেনাবাহিনী বলে চিৎকার করছেন, তার মানে একটা উসকানিমূলক প্রবণতা সৃষ্টি করতে চাইছেন। সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরকারের একটা বিরোধ বাধানোর জন্য বিএনপি বারবার এ উসকানি দিচ্ছে। এটা কিন্তু দেশের জন্য ভালো নয়। এখনো সেনাবাহিনী মোতায়েনের মতো পরিস্থিতি হয়নি। তাহলে অযৌক্তিক এ দাবিটা করে সেনাবাহিনীকে কেন বিতর্কিত করতে চাইছেন?
এর আগে গত ১৮ এপ্রিল রাজধানীর হাতিরঝিলের মোবাইল কোর্টের কার্যক্রম পরিদর্শন করে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের কাছে বলেন, যখন আপনারা ক্ষমতায় ছিলেন, তখন কি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সেনা মোতায়েন হয়েছে! জাতীয় কোন নির্বাচনে সেনা মোতায়েন হয়েছে! সেটা কেন এখন নিজেরা বিরোধী দলে থেকে নিজেদের অবস্থা খারাপ দেখে এসব আবোল-তাবোল বকছেন।
নির্বাচনে সেনা মোতায়েন জরুরি কেন, সে সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল গত বছরের শেষ দিকে পত্রিকায় এটি নিবন্ধন লেখেন। এর একটি অংশে তিনি উল্লেখ করেন, ভোটের আগে নির্বাচনী এলাকাগুলোয় পুলিশবিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেও নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে। বর্তমান সরকারের আমলে বিভিন্ন রাজনৈতিক মামলায় ঢালাওভাবে বিএনপির জোটের নেতাকর্মীদের অভিযুক্ত করা হয়েছে। নির্বাচনের সময় এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে পুলিশের পক্ষে ব্যাপক গ্রেপ্তার ও এলাকাছাড়ার ভীতি তৈরি করা সম্ভব। পুলিশের মধ্যে যেভাবে দুর্নীতি ও অপহরণের মতো অপরাধপ্রবণতার খবর আমরা পাই, তাতে মনে হয়, নির্বাচনকালে গ্রেপ্তার-বাণিজ্যে মেতে ওঠাও তাদের কারও কারও পক্ষে সম্ভব।
আবার সরকারের পক্ষে সম্ভব বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ করে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা। সেনাবাহিনী নির্বাচনের কয়েক দিন আগে থেকে ভোটকেন্দ্রে মোতায়েন থাকলে, বিশেষ করে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা অন্যায় হয়রানির ভয় থেকে অনেকাংশে মুক্ত থাকেন। সরকারি দলের বিভিন্ন মাস্তান বাহিনীর পক্ষেও স্বেচ্ছাচারিতা করার আত্মবিশ্বাস কমে যায়। এর কারণ হচ্ছে, সেনাবাহিনী দেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যেখানে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগের সুযোগ নেই। সেনাবাহিনী নির্বাচনকেন্দ্রে মোতায়েন থাকলে তাই সরকারি হোক, বিরোধী দলের হোক, সন্ত্রাসীদের পক্ষে তাÐবলীলা চালানোর সাহস হয় না।
সেনা মোতায়েন
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনে ১৫ দিন মোতায়েন ছিল সেনাবাহিনীর সদস্যরা। ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ২৬ ডিসেম্বর থেকে ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন রাখা হবে।
সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সশস্ত্র বাহিনী নিয়োগ দেয় ইসি। প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারের কাছে ইসির সিদ্ধান্তের বিষয়টি চিঠিতে পাঠায় ইসি সচিবালয়।
সশস্ত্র বাহিনীর কার্যপরিধির বিষয়ে চিঠিতে বলা হয়, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৩০ ও ১৩১ ধারা এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা ‘ইন্সট্রাকশন রিগার্ডিং ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’-এর সপ্তম ও দশম অনুচ্ছেদের ক্ষমতা ও নিয়মানুযায়ী নির্বাচনের সময় সশস্ত্র বাহিনী পরিচালিত হবে। মোতায়েন করা সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের কাজ হবে নির্বাচনী কাজে ম্যাজিস্ট্রেটের পরিচালনায় বেসামরিক প্রশাসনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়তা করা।
সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা প্রতিটি জেলা/উপজেলা/মহানগর এলাকার ‘নোডাল পয়েন্ট’ এবং অন্যান্য সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নেবেন এবং ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স’ হিসেবে নিয়োজিত থাকবেন।
রিটার্নিং কর্মকর্তার সঙ্গে সমন্বয় করে উপজেলা/থানায় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করতে হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানে সহযোগিতার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, মহাসড়কে নিরাপদ যান চলাচল নিশ্চিত করতে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কাজ করবেন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা।
২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও ২৬ থেকে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তায় সেনাবাহিনীকে রাখা হয়েছিল। তাতেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সেনাবাহিনী। চিঠিতে বলা হয়, সেনাসদস্যরা সেনানিবাসের ভেতরেই থাকবেন। রিটার্নিং কর্মকর্তারা অনুরোধ করলে তারা বাইরে আসবেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন