দেশে বিতর্কিত ব্যবসায়ী ধনুকবের মুসা বিন শমসেরের বড় ছেলে ববি হাজ্জাজের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল এনডিএমের অর্থের জোগান নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে। গেল বছর আত্মপ্রকাশ হওয়া দলটির চেয়ারম্যান ববির সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বক্তব্যকে ঘিরে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মাদ নাসিম, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে কিছুদিন আগে নানা অভিযোগ তুলে প্রকাশ্যে জনসম্মুখে বক্তব্য রাখেন ববি। তার এসব বক্তব্যকে ঘিরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, ২০ দলীয় জোটের শরিক দল বিএনপিসহ জাতীয় পার্টির নেতাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে তার অর্থের যোগান নিয়ে প্রকাশ্যে প্রশ্ন না তুললেও ভেতরে ভেতরে খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে। কারণ হঠাৎ বড় গলায় বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন দেশের খ্যাতিমান রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। ববির পেছনে কারা জড়িত তা ভাবিয়ে তুলছে তাদেরকে।
এদিকে ‘দেশ হবে জনতার’ স্লোগানে গতবছর ২৪ এপ্রিল ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বড় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাজধানী ঢাকার ঐতিহাসিক ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে আত্মপ্রকাশ করা জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এনডিএম। যার নেতৃত্বে দিয়ে যাচ্ছেন বিতর্কিত ধনকুবের মুসা বিন শমসেরের বড় ছেলে ববি হাজ্জাজ। পূর্বে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকলেও পারিবারিক অর্থের জোর আর একসময় সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিশেষ রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করে আলোচনায় আসেন ববি।
গেল দশম নির্বাচনে ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের আগে এরশাদের মুখপাত্র হিসেবে নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে অবস্থান নেয়ায় তাকে লন্ডনে পাঠিয়ে দেয় র্যাব। সেই সময় নানা গুঞ্জন শুনা যায়। তবে সংস্থাটি এই অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে বলছেন ববি স্বেচ্ছায় লন্ডনে পাড়ি জমান।
অপরদিকে একসময় জাতীয় পাটর মহাসচিব হিসেবে আলোচনায় ববির নাম থাকলেও মূলত এরশাদের সকাল-বিকাল মত পরিবর্তন নিয়ে বিরোধের সূত্র ধরেই নতুন দল গঠন করেন ববি হাজ্জাজ।
অভিযোগ রয়েছে দলীয় প্রচার-প্রচারণায় শুরু থেকেই জয় বাংলাদেশ ব্যবহার করায় দলটিকে মহাজোটের নতুন ট্রাম্প কার্ড হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের আবেদন করা ৭৬ দলের মধ্যে ইতিমধ্যে যোগ্যদলের সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পেয়েছে বিতর্কিত মুসা বিন শমসের ছেলের হাতে গড়া এনডিএম। এমন তথ্যও শুনা যাচ্ছে।
দলটির একাধিক সূত্র মানবকণ্ঠকে জানায়, মাত্র এক বছরের মধ্যে চট্টগ্রাম, সিলেট এবং রংপুর বিভাগের প্রতিনিধি সম্মেলন এবং ২৩টি জেলা সদরে জেলা সম্মেলন আয়োজন করায় প্রশ্ন উঠেছে দলীয় তহবিলের উৎস এবং সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা নিয়ে। প্রভাবশালী প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ববির ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও রাজনৈতিক সফর এবং এনডিএমের আত্মপ্রকাশের আগে পশ্চিমা দেশগুলোর আগ্রহ দেখে বিদেশি অর্থায়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির কিছু নেতা।
অভিযোগ রয়েছে পানামা পেপারসে প্রকাশিত মুসা বিন শমসেরের বিদেশে অফসোর কোম্পানি থেকে বাংলাদেশে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনার জন্যই ছেলেকে দিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল শুরু করেছেন তিনি। বিপুল অর্থের জোগানের কারণে মহাজোটের সমমনা শরিক দলগুলো ও ২০ দলীয় জোটের সমমনা দলগুলোর নেতাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে এনডিএম নিয়ে। এমনটি জানিয়েছেন ২০ দলীয় শরিক দলগুলোর এক শীর্ষ নেতা। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রাজনীতি এখন ধনীক শ্রেণির হাতে চলে যাচ্ছে, যার প্রমাণ ববি হাজ্জাজ। একইভাবে অভিযোগ করেন ১৪ দলীয় জোটের ইসলামীপন্থি একটি দলের চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, টাকা থাকলে রাজনীতি এখন সহজ। টাকা নেই রাজনীতি নেই।
সূত্র জানায়, আদালতের রায়ে স্থগিত হয়ে যাওয়া ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মাইলস ব্যান্ডের ভোকাল ও দলটির উচ্চ পরিষদ সদস্য শাফিন আহমেদকে মেয়র পদে সমর্থন দিয়ে আলোচনার জš§ দেয় ববির দল এনডিএম। সাম্প্রতিক ঢাকার বিভিন্ন গণসংযোগ ও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে দলটির চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জাসদের সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর তীব্র সমালোচনা করে বক্তব্য রাখায় তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে সরকারের শরিক দলগুলোর মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা-১৭ আসন থেকে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করবেন ববি হাজ্জাজ। বর্তমানে এই আসনে এমপি রয়েছেন বিএনএফের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ। আর সরকারের মিত্র জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও এ আসনে নির্বাচন করতে চান। আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে বাইরে রেখে জাতীয় সংসদে গ্রহণযোগ্য নতুন ও পুরনো বেশকিছু দলকে সুযোগ করে দেয়ার পরিকল্পনায় শেষ মুহূর্তে এই আসনে এনডিএমকে ছাড় দিতে পারে আওয়ামী লীগ। একইভাবে চট্টগ্রাম-৯ আসন থেকে জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলুর স্থানে জাতীয় পার্টিরই সাবেক নেতা ও এনডিএমের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক খোকন চৌধুরী বিবেচনায় আসতে পারেন। বরিশাল-৩ আসনে মহাজোটের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির বর্তমান এমপির জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ এনডিএমের ভাইস চেয়ারম্যান (শিল্প ও বাণিজ্য) এনায়েত কবির। তিনিও এনডিএমকে মহাজোটের শরিক দল বানাতে সরকারের একটি অংশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন। এমনটি জানিয়েছে দলটির একটি গোপন সূত্র।
এনডিএমের এক শীর্ষ নেতা গতকাল মানবকণ্ঠকে বলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি বি চৌধুরীর ছেলে মাহি বি চৌধুরীর সমঝোতার স্বপ্ন ভেঙে যেতে পারে এই আসন থেকে এনডিএম মহাসচিব অধ্যাপক আব্দুল্লাহ এম তাহেরের নির্বাচনের খবরে। তবে এসব নিয়ে জানতে চেয়ে কথা বলতে চাইলেও ফোন রিসিভ করেননি দলটির মহাসচিব অধ্যাপক তাহের।
তবে দলটির চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ ও তার বিশেষ সহকারী মোমিনুল আমিন মানবকণ্ঠকে বলেন, এনডিএম নির্বাচনমুখী দল। প্রায় ৬৩টি আসনে আমরা সাবেক এমপি, জেলা পরিষদ, পৌর ও উপজেলা চেয়ারম্যানদের এমপি প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করে রেখেছি। তিনি বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারের মিত্র জাতীয় পার্টি, মহাজোটের শরিক দলসমূহ এবং বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক দলগুলো নিয়ে নানা হিসাব নিকাশ চলছে। তিনি আরো জানান, আমরা এবারের নতুন সম্ভাব্য নিবন্ধিত দল নিয়েও বৈঠকে বসব। আগামী রোজার ঈদের পরই নির্বাচনী মাঠে খেলা শুরু হওয়ার অপেক্ষা। দলের অর্থের যোগান কোথায় থেকে আসছে জানতে ববি হাজ্জাজের ফোনে কল দিলে তিনি রিসিভ করেননি।
মানবকণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন