বাংলাদেশ নিয়ে জার্মান গবষেণা প্রতিষ্ঠান ‘বেরটেলসম্যান স্টিফটুং’-এর প্রতিবেদন প্রকাশের পর দেশের রাজনীতিতে ব্যাপক উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও সাধারণ মানুষের মধ্যেও এনিয়ে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া লক্ষ্যণীয়। তবে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া সম্পূর্ণ বিপরীত।বাংলাদেশকে ‘স্বৈরতান্ত্রিক’ দেশ আখ্যায়িত করে দেয়া জার্মান গবষেণা প্রতিষ্ঠান ‘বেরটেলসম্যান স্টিফটুং’-এর প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির নীতিনির্ধারকেরা এ প্রতিবেদনের কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, যখনি বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে প্রবেশ করছে এবং দেশের মানুষ আনন্দ উল্লাস করছে ঠিক সেই মুহূর্তে এই আনন্দকে ম্লান করার জন্য এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলেও দাবি করেন তারা।
বাংলাদেশ এখন স্বৈরশাসনের অধীন এবং সেখানে গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদণ্ড পর্যন্ত মানা হচ্ছে না বলে মন্তব্য করে জার্মান ওই গবেষণা প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের ১২৯টি দেশে গণতন্ত্র, বাজার অর্থনীতি এবং সুশাসনের অবস্থা নিয়ে এক সমীার পর জার্মান প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টটি গত শুক্রবার প্রকাশ করা হয়।২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত যেসব দেশের ওপর এই সমীক্ষা চালানো হয় তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে পাঁচটি দেশের কথা। এগুলো হলো- বাংলাদেশ, লেবানন, মোজাম্বিক, নিকারাগুয়া ও উগান্ডা।প্রসঙ্গত, ১২৯টি দেশের গণতন্ত্রের অবস্থা নিয়ে যে সূচক এ সীমার ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান ৮০ নম্বরে। একই অবস্থানে আছে রাশিয়া।উরুগুয়ে, এস্তোনিয়া ও তাইওয়ান আছে এ সূচকের শীর্ষে। আর একেবারে তলায় রয়েছে সোমালিয়া, ইয়েমেন ও সিরিয়া।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানের অবস্থান অবশ্য বাংলাদেশের নিচে- ৯৮ নম্বরে। মায়ানমারের অবস্থান ১০৪ নম্বরে। অন্য দিকে ভারত আছে বেশ উপরের দিকে- ২৪ নম্বরে। শ্রীলঙ্কার অবস্থান ৪১ নম্বরে।‘বেরটেলসম্যান স্টিফটুং’ ২০০৬ সাল থেকে নিয়মিতভাবে এ ধরনের রিপোর্ট প্রকাশ করে আসছে। যা বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। নিরপেক্ষ প্রতিবেদন প্রকাশের ব্যাপারে সারাবিশ্বে এ প্রতিষ্ঠানের সুনাম-সুখ্যাতি রয়েছে।রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই পাঁচটি দেশ এখন আর গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদণ্ড পর্যন্ত মানছে না। এসব দেশে বহু বছর ধরেই ‘গণতন্ত্র’ ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে। এসব দেশের ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনী ব্যবস্থার কারণেই এটা ঘটেছে বলে উল্লেখ করা হয় রিপোর্টে।রিপোর্টে বলা হয়, এই পাঁচটি নতুন স্বৈরতান্ত্রিক দেশের পথ অনুসরণ করতে যাচ্ছে আরো কয়েকটি ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের দেশ; এগুলো হলো হন্ডুরাস, হাঙ্গেরি, মলডোভা, নাইজার, ফিলিপাইন ও তুরস্ক।
তবে রিপোর্টে কিছু কিছু দেশে গণতান্ত্রিক অগ্রগতির প্রশংসা করা হয়েছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে আর্জেন্টিনা, মরিশাস ও উরুগুয়ে।রিপোর্টটির ব্যাপারে প্রশ্ন তুলে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বিবিসিকে বলেন, ‘যে সমীার ভিত্তিতে রিপোর্টটি করা হয়েছে, সেটির তথ্য তারা কোথায় পেয়েছে? রিপোর্টটি যদি ২০১৫ সাল থেকে নেয়া তথ্যের ভিত্তিতে হয়ে থাকে, তাহলে সে বছর তো বাংলাদেশে উল্টো ঘটনা ঘটছিল।’‘বাংলাদেশে বিরোধী দল বিএনপি যে অগ্নি-সন্ত্রাস শুরু করেছিল, তখন বাংলাদেশে সাধারণ মানুষ চরমভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছিলেন, তাদেরকে বিভিন্ন জায়গায় হত্যা করা হচ্ছিল, আহত করা হচ্ছিল।’এইচ টি ইমাম বলেন, বাংলাদেশে যারা গণতন্ত্র বা নির্বাচন নিয়ে কাজ করেন, তাদের কারো কাছে কখনো তিনি এ রকম কোনো সমীা হচ্ছে বলে শোনেননি।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদণ্ড পর্যন্ত রা করা হচ্ছে না বলে রিপোর্টে যে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, সে প্রসঙ্গে এইচ টি ইমাম বলেন, ‘গণতন্ত্রের মানদণ্ড কি আমাদের জার্মানির কাছ থেকে শিখতে হবে? হিটলারের দেশ থেকে?’২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়ে যেসব প্রশ্ন তোলা হয়েছে, সেসব পরবর্তীকালে বিশ্বের সব দেশ মেনে নিয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘ওই নির্বাচন সঠিকভাবে হয়েছে, সবাই অংশ নিয়েছে। ওই নির্বাচনের পরে যদি এই সমীা হয়ে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে এর পেছনে অন্য কারণ আছে।’বাংলাদেশে নাগরিক অধিকার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে রিপোর্টে যে প্রশ্ন তোলা হয়েছে তার জবাবে এইচ টি ইমাম বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন ঢাকা থেকেই প্রকাশিত হয় প্রায় তিন শ’র বেশি দৈনিক। প্রত্যেকটি সংবাদপত্র কিভাবে লিখছে আপনারা দেখতে পারেন।
প্রত্যেকটি টেলিভিশনের টক শো যদি আপনি দেখেন, সেখানে কি মতপ্রকাশের অধিকার নেই, স্বাধীনতা নেই? বাংলাদেশে মোটেই কোনো কিছু সেন্সর করা হচ্ছে না।’রিপোর্ট প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘এ ধরনের প্রতিবেদন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। যখনি বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নত দেশে প্রবেশ করেছে এবং দেশের মানুষ আনন্দে উদ্বেলিত- এই আনন্দকে ম্লান করার জন্য এ অসত্য সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে। যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে আমাদের অগ্রযাত্রা মেনে নিতে পারেনি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা-অগ্রগতি-উন্নয়নকে তুচ্ছ-তাচ্ছিলের চোখে দেখেছে, তাদের ষড়যন্ত্রের অংশ এই প্রতিবেদন। তারা রিপোর্টে অসত্য তথ্য পরিবেশন করেছে। এ ধরনের গবেষণা বাংলাদেশ প্রত্যাখ্যান করেছে।’
দলের অন্যতম প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু রিপোর্টটি প্রত্যাখ্যান করে প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘সম্পূর্ণ ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এতে সরকারবিরোধী পক্ষের প্রভাবও থাকতে পারে, যা দেশের বিরুদ্ধে পুরোপুরি ষড়যন্ত্র। কারণ, দেশ যখন উন্নয়নের সব সূচকেই এগিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখন এ ধরনের প্রতিবেদন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমরা এটি প্রত্যাখ্যান করছি।’আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনামলে যে অপশাসন হয়েছে এবং ২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে আন্দোলনের নামে পেট্রল বোমায় যেসব অপকর্ম করা হয়েছে এসবের চিত্র ধরে এই প্রতিবেদন হতে পারে। এই প্রতিবেদনে বর্তমান সরকারের সময়ের চিত্র তুলে ধরে করা হয়নি।’
দলের অন্যতম সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘দেশে জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত একটি সরকার রয়েছে। সংসদ কার্যকর এবং গণমাধ্যমও স্বাধীন। দেশবাসী উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের উদযাপনে ব্যস্ত। ঠিক সেই মুহূর্তে এ ধরনের প্রতিবেদন পুরোপুরি ষড়যন্ত্র। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের বিরুদ্ধে দেশ-বিদেশে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছিল। সেসব ষড়যন্ত্রকারীরা এখনো সক্রিয় রয়েছে। তবে তাদের এসব ষড়যন্ত্র বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে পারেনি, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা এসব অসত্য প্রতিবেদন ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি।’অন্যদিকে এই প্রতিবেদনে বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন হয়েছে বলে মনে করছে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি।
বাংলাদেশ এখন স্বৈরশাসনের অধীন এবং সেখানে গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদণ্ড পর্যন্ত মানা হচ্ছে না বলে জার্মান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মন্তব্যের পক্ষে প্রতিক্রিয়ায় নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা এত দিন ধরে যে কথাগুলো বলছিলাম আজকে তা বিশ্বে স্বীকৃত হয়েছে। এই গবেষণার মধ্য দিয়ে আমাদের বক্তব্যের প্রতিফলন হয়েছে।’বিশ্বের ১২৯টি দেশে গণতন্ত্র, বাজার অর্থনীতি এবং সুশাসনের অবস্থা নিয়ে এক সমীক্ষার পর জার্মান প্রতিষ্ঠান 'বেরটেলসম্যান স্টিফটুং’ মন্তব্য করে, ‘বাংলাদেশ এখন স্বৈরশাসনের অধীন এবং সেখানে এখন গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদণ্ড পর্যন্ত মানা হচ্ছে না।’রিপোর্টটি শুক্রবার প্রকাশ করা হয় যা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
অন্যদিকে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব বলেন ‘এই গবেষণায় আমরা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে, গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে যারা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম তারা অত্যন্ত লজ্জাবোধ করছি। এবং আমরা এর নিন্দা জানাচ্ছি’।ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘সরকার স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে বাংলাদেশকে আজ এই অবস্থায় নিয়ে গেছে।’অন্যদিকে আরেক প্রতিক্রিয়ায় লন্ডন থেকে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা আবু সায়েম বলছেন, ‘গত নয়টি বছর বাংলাদেশ শাসিত হচ্ছে কেবল এক ব্যক্তির তুঘলকি খেয়ালখুশিতে। ভিন্নমত দমনে প্রয়োগ করা হয়েছে গুম, খুন, নির্যাতন ও মিথ্যা মামলার মতো পৈশাচিক সব পদ্ধতি।’দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলার সমালোচনা করে তিনি উল্লেখ করেন, ‘বিদ্যমান আইন ও কার্যবিধির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে তাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে শত বছরের পুরানো ও পরিত্যক্ত কারাগারে।’
‘অন্যদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও সরকারের স্বৈরাচারী মানসিকতার শিকার। বেআইনি পন্থায় আদালতকে প্রভাবিত করে তার বাক-স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে। গত প্রায় দশ বছর লন্ডনে নির্বাসনে থাকা সত্ত্বেও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে সত্তরটির ওপরে মামলা।’‘বেরটেলসম্যান স্টিফটুং’-এর সমীক্ষা প্রতিবেদন নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের বক্তব্যেরও সমালোচনা করেন তিনি।সায়েম অভিযোগ করেন, সরকার ‘বরাবরের মতো এবারো বিএনপির কাঁধে বন্দুক রেখে কলঙ্কের বৈতরণী পার হতে চাচ্ছে।’এসময় তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ‘অবাধ, সুস্ঠু ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানান।এছাড়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘একদলীয় নির্বাচন যদি হতে দেই, তাহলে আমাদের দেশের অস্তিত্ব থাকবে না। বর্তমান সরকার এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি স্বৈরতান্ত্রিক সরকার।’শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের কনফারেন্স লাউঞ্জে ‘খালেদা জিয়া মুক্তি পরিষদ’-এর কেন্দ্রীয় কমিটি আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
rtnn
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন