স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর ১৯৭১ সালের ‘শত্রু’ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশংসায় মেতেছে পাকিস্তানি সেনাদের দোসর হিসেবে তাদেরকে খুন করতে অস্ত্র ধরা জামায়াতে ইসলামী। এখন তাদের দৃষ্টিতে ‘মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান’।
সোমবার ৪৭তম স্বাধীনতা দিবসের দুই দিন আগে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির আ ন ম শামসুল ইসলাম এই প্রশংসা করেন।
বিবৃতিতে আগামী ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসকে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করতে দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের প্রতি আহ্বান জানান জামায়াতের আমির।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের পর আক্রান্ত দেশবাসীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সেনাবাহিনীর পদলেহন করে জামায়াত।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রাজাকার, আলবদরসহ নানা বাহিনী গড়ে, পূর্ব পাকিস্তান সরকারে যোগ দিয়ে নানাভাবে সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেছে জামায়াতে ইসলামী। যুদ্ধের শেষ দিকে বুদ্ধিজীবী হত্যায়ও জড়িত ছিল জামায়াতের সে সময়ের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ। এই সংগঠনটি এতটাই কুখ্যাত হয়ে উঠে যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ পেয়ে এই নামে সংগঠন না খুলে ইসলামী ছাত্রশিবির নামে ছাত্র শাখা খুলে জামায়াত।
তবে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জামায়াত তার ভোল পাল্টানোর চেষ্টা করছে। সে সময় ভুয়া ‘মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন’ও খুলেছিল জামায়াত। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ নামে ওই সংগঠনের কমিটিতে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে জামায়াতের বিভিন্ন নেতা ও সমর্থকদেরকে রাখা হয়।
কিন্তু সে সময় গণমাধ্যমে এই প্রতারণা ফাঁস হয়ে যায়। আবার সংগঠনের এক অনুষ্ঠানে প্রতিবাদ জানাতে যাওয়া এক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাকে মারধরের পর এই সংগঠনটি আর প্রকাশ্যে আসেনি।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র করেও সে সময় জামায়াতের নেতা-কর্মীরা বানোয়াট ইতিহাস প্রচারের চেষ্টায় ছিল। তবে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন আসার পর বিশেষ উদ্দেশ্যে শুরু হওয়া সে কাজও বন্ধ হয়ে যায়। এরপরও জামায়াত জাতীয় দিবসগুলোতে তাদের ৭১ এর ভূমিকা আড়াল করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশংসায় মাততে শুরু করে।
মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নও জানে জামায়াত
৪৭ বছর পর এসে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ‘জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান’ আখ্যা দিয়ে জামায়াত প্রধানের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা ও লাখ জনতার সীমাহীন ত্যাগ এবং কুরবানির বিনিময়ে আমরা মহান স্বাধীনতা অর্জন করেছি।’
‘ক্ষুধা, দারিদ্র ও বেকারত্ব মুক্ত কল্যাণমূলক একটি দেশ প্রতিষ্ঠার জন্য এ দেশের সাহসী সন্তানেরা যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, তারই ধারাবাহিকতায় বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।’
মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন কী ছিল, সেটাও এখন জানে জামায়াত। দলের ভারপ্রাপ্ত আমিরের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এ দেশের মানুষের স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অধিকার, ভাতের অধিকার, ভোটের অধিকার ও বেঁচে থাকার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। জনগণের জানমাল, ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।’
স্বাধীনতার ৪৭ বছরেও জনগণের সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি দাবি করে জামায়াতের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘সরকার জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছে। দেশে চলছে সীমাহীন দুর্নীতি, সন্ত্রাস, লুটপাট, হত্যা, ধর্ষণ, গুম, অপহরণ ও নৈরাজ্য।’
‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, হত্যা, খুন, গুম, অপহরণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বাংলাদেশকে এক রক্তাক্ত জনপদে পরিণত করেছে।’
৭১ এর ভূমিকা আড়াল করে জাতীয় ঐক্য চায় জামায়াত
৭১ এর ভূমিকা আড়াল করে রেখে জামায়াত এখন ‘জাতীয় ঐক্য’ও চায়। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘জাতির উন্নতি ও কল্যাণের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য ও গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। কিন্তু সরকার জাতীয় ঐক্য ধ্বংস করে জাতিকে বিভক্তির দিকেই ঠেলে দিচ্ছে এবং গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে।’
জাতীয় ঐক্য, ‘গণতন্ত্র, ভোটাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার’ প্রত্যয় নিয়ে ২৬ মার্চ ‘যথাযোগ্য মর্যাদায়’ স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস পালনে জামায়াতের সব শাখা এবং দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান দলের ভারপ্রাপ্ত আমির।
গোলাম আযমের লেখনিতে জামায়াতের ৭১ এর ভূমিকা
জামায়াতে ইসলামী মুক্তিযুদ্ধের সময় কী কী করেছে, সেটি দলটির সাবেক আমির গোলাম আযমের জীবনে যা দেখলাম বইয়েই স্পষ্ট। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দালালি, গণহত্যায় তাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ আছে বইয়ের পরতে পরতে।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণ শুরুর ১১ দিনের মাথায় পূর্ব পকিস্তান জামায়াতের আমির গোলাম আযম বেশ কিছু ধর্মভিত্তিক দলের নেতাদেরকে নিয়ে সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেন।
গোলাম আযম তাঁর আত্মজীবনী ‘জীবনে যা দেখলাম’ তৃতীয় খণ্ডে লেখেন, জামায়াত মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সামরিক বাহিনীকে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন (পৃ-১৪৪)।
টিক্কা খানের নির্দেশ অনুযায়ী গোলাম আযম পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার আহ্বান জানিয়ে রেডিওতে ভাষণও দেন। ওই ভাষণ প্রচারের পর সারা দেশে জামায়াতের নেতা-কর্মীরা আওয়ামী লীগের হুমকির মুখে পড়ে- সেটাও লিখেছেন গোলাম আযম।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে জামায়াতের আঁতাতের সাফাই গেয়ে গোলাম আযম লেখেন, '...জনগণের সামান্য খিদমত করতে হলে সামরিক সরকারের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমেই তা সম্ভব' (তৃতীয় খণ্ড, পৃ-১৪৩)।
যুদ্ধ চলাকালে মে মাসে সে সময়ের খুলনায় খানজাহান আলী রোডে একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন জামায়াত কর্মী নিয়ে রাজাকার বাহিনীর প্রথম ইউনিট গঠন করেন সে সময় পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের ডেপুটি আমির আবুল কালাম মোহাম্মদ ইউসুফ। যুদ্ধ চলাকালে গভর্নর মালেকের অধীনে মন্ত্রিসভায়ও যোগ দেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর নানা অপকর্মের সহযোগী রাজাকার বাহিনীকে দেশপ্রেমিক এবং মুক্তিযুদ্ধকে নাশকতামূলক তৎপরতা উল্লেখ করে গোলাম আযম তার বইয়ে লেখেন, ‘যে রেযাকাররা (রাজাকার) দেশকে নাশকতামূলক তৎপরতা থেকে রক্ষার জন্য জীবন দিচ্ছে তারা কি দেশকে ভালবাসে না? তারা কি জন্মভূমির দুশমন হতে পারে?’
যুদ্ধের শেষে দিকে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী বুঝতে পেরে গোলাম আযম পাকিস্তান পালিয়ে যান এবং সেখানে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পাকিস্তাানকে বাঁচাতে রাজাকারদেরকে ভারী অস্ত্র দেয়ার দাবি জানান।
মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠন করা খুনি বাহিনী আলবদর ছিল জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা-কর্মীদের নিয়ে গঠিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশের মানুষের ওপর সবচেয়ে বেশি নৃশংসতা চালানোর অভিযোগ আছে এই বাহিনীর বিরুদ্ধে।
বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়েই আলবদর বাহিনীর কমান্ডার মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সংগঠক মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।
১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক গোপন প্রতিবেদনে দেখা যায়, মতিউর রহমান নিজামী মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সব রকমের সাহায্য করতে দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান। আলী আহসান মুজাহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিহত করতে আলবদর বাহিনী গড়ে তুলতে দলের নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দেন।
নিজামী একাত্তর সালের ১৪ জুন জামালপুরে ইসলামী ছাত্রসংঘের এক সভায় বলেন, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেনাবাহিনী যেভাবে কাজ করছে তাতে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করা সম্ভব। ইসলাম রক্ষায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী-কে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করতে হবে।’
১৭ অক্টোবর রংপুরে পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের এক সভায় মুজাহিদ আলবদর বাহিনী গড়ে তুলতে নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন মানবতাবিরোধী অভিযোগে ফাঁসির দণ্ড পাওয়া এ টি এম আজহারুল ইসলাম। তিনি যুদ্ধ চলাকালে আলবদর বাহিনীর রাজশাহী জেলা শাখার প্রধান ছিলেন। একাত্তর সালের ৭ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামী আলবদর দিবস পালন করে। ৬ সেপ্টেম্বর ইসলামী ছাত্রসংঘ ঢাকা মাদ্রাসায়ে আলিয়ায় ‘পাকিস্তান রক্ষা দিবস’ পালন করে।
ফাঁসিতে ঝুলা মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের তত্ত্বাবধানে মুক্তিযুদ্ধকালে বৃহত্তর ময়মনসিংহে আলবদর বাহিনী গঠিত হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ আগস্ট জামায়াতের মুখপাত্র দৈনিক সংগ্রাম-এর একটি প্রতিবেদনে কামারুজ্জামানকে ময়মনসিংহে আলবদর বাহিনীর প্রধান সংগঠক হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
জামায়াতের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতা আব্দুস সুবহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাবনার শান্তি কমিটির প্রধান ছিলেন।
ঢাকাটাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন